মো: মছব্বির আলী, মৌলভীবাজার:
জেলার বিভিন্ন উপজেলায় সহজ-সরল নারীদের ‘ফু’ দিয়ে টাকা দ্বিগুণ করার প্রলোভন দেখিয়ে ছিনতাই, টাকা আত্বসাত চক্রের আবির্ভাব ঘটেছে মৌলভীবাজার জেলায়। গত কয়েক মাসে এরকম বেশ ক’টি প্রতারনার স্বীকার হয়েছেন কয়েকজন মহিলা। খুঁইয়েছেন লাখ লাখ টাকা। পুলিশ কয়েকজনকে আটক করলেও থামছেনা এদের অপকর্ম। দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে এসব প্রতারণা। ভুক্তভোগিরা ব্যাংকগুলোর আশেপাশে গোয়েন্দা নজরদারী বাড়ানোর জন্য প্রশাসনের কাছে জোর দাবী জানিয়েছেন।
৩ অক্টোবর মঙ্গলবার, জুড়ী উপজেলার সদর জায়ফরনগর ইউনিয়নের কালিনগর গ্রামের গৃহবধূ সাইদা বেগম মৌলভীবাজারে কলেজ পড়ুয়া মেয়ের জন্য ৩১ হাজা টাকা উত্তোলন করেন। প্রতারক চক্র ‘ফুঁ’ দিয়ে ৩০ হাজার টাকা নিয়ে যায়। মহিলার আর্তচিৎকারে মানুষজন জড়ো হওয়ার আগেই প্রতারকরা সটকে পড়ে।
২৫ সেপ্টেম্বর সোমবার, বড়লেখা উপজেলায় টাকায় বরকত বাড়ানোর ‘ফুঁ’ দেওয়ার নামে কাতার প্রাবসীর স্ত্রীর ৭৩ হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়েছে একটি প্রতারক চক্র।
ঐ দিন দুপুরে বড়লেখা পৌরশহরে অভিনব কায়দায় প্রতারণার এই ঘটনাটি সিসি ক্যামেরায় ধরা পড়ে।
এ ঘটনায় ভোক্তভোগী ছাবিয়া বেগম ওইদিন বিকেলে থানায় লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। তিনি উপজেলার সুজানগর ইউপির বড়থল গ্রামের কাতার প্রবাসী ছুয়াব আলীর স্ত্রী।
ছাবিয়া বেগম জানান, দুপুর ১২টা ১৫ মিনিটের সময় পূবালী ব্যাংক বড়লেখা শাখা থেকে স্বামীর পাঠানো ৭৫ হাজার টাকা উত্তোলন করেন। ব্যাংক থেকে নেমে বড়লেখা পৌরশহরের লক্ষ্মী মিষ্টি ঘরের সামনে পৌঁছালে ৫০ বছর বয়সী এক ব্যক্তি হঠাৎ ছাবিয়া বেগমের মাথা ও মুখে হাত বুলিয়ে বলেন, আমি নামাজ পড়তে আসি।
তখন তিনি ওই ব্যক্তির পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেলে এক যুবক তার পথ আগলে বলে, ওই বাবা কি বলেছেন? উনি অনেক বড় পীর, উনার কথা শুনলেন না কেন। পথ আগলে ওই যুবক ছাবিয়া বেগমকে কথিত পীরের কাছে নিয়ে যায়।
এসময় ছাবিয়া বেগম দেখতে পান ৫০/৫৫ বছর বয়সী ওই ব্যক্তি মধ্যবয়স্ক আরো এক ব্যক্তির টাকা হাতে নিয়ে ‘ফুঁ’ দিয়ে ফেরত দিচ্ছেন।
তখন ওই ব্যক্তি ছাবিয়াকে বলেন (কথিত পীর), তোমার নিকট টাকা আছে। টাকাগুলা দেও। টাকা পড়ে ‘ফুঁ’ দিই। টাকার বরকত হবে।
তখন তিনি ব্যাংক থেকে তুলে ব্যাগে রাখা ১ হাজার টাকার ২৩টি নোট ও ৫০০ টাকার ১০০টি নোটে ৭৩ হাজার টাকা ওই ব্যক্তির হাতে দেন। দুই হাজার টাকা ছোট নোট হওয়ায় সে ওইগুলো নেয়নি।
মুহুর্তেই ওই ব্যক্তি টাকাগুলো হাতিয়ে ছাবিয়ার ব্যানেটি ব্যাগে দিয়েছে বলে পেছন দিকে না তাকিয়ে দ্রুত চলে যেতে বলে। সামান্য এগিয়ে যাওয়ার পর ছাবিয়া বেগম দেখতে পান তার ব্যানেটি ব্যাগে টাকা নেই।
সিসি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা গেছে, বোরকা পরা ছাবিয়া বেগমের পাশে হলুদ টিশার্ট পরা মূল প্রতারকের সহযোগী এক যুবক দাঁড়িয়ে আছে। ডানপাশে পাঞ্জাবি পরা মূল প্রতারক টাকায় বরকত বাড়ানোর ‘ফুঁ’ দিতে ওই নারীর কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।
ভোক্তভোগী ছাবিয়া বেগমের ছেলে আব্দুজ আজিজ জানান, ‘আমার আম্মা পুবালী ব্যাংক বড়লেখা শাখা থেকে আব্বার পাঠানো ৭৫ হাজার টাকা তুলে নিচে নামতেই প্রতারকরা উনার কাছ থেকে ৭৩ হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।
অবশিষ্ট ২ হাজার টাকা ছোট নোট হওয়ায় সেগুলোতে ‘ফু’ লাগবেনা বলে নেয়নি। আমরা থানায় লিখিত অভিযোগ করেছি। পুলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে। আজ দুপুরেও থানায় গিয়ে আম্মা জবানবন্দি দিয়েছেন।
বড়লেখা থানার ওসি ইয়ারদৌস হাসান বলেন, অভিযোগ পাওয়ার পরই পুলিশ ঘটনাটি তদন্তে নেমেছে। প্রতারক চক্রকে শনাক্ত ও গ্রেফতারের জন্য পুলিশ তদন্ত কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।
১৪ মার্চ মঙ্গলবার দুপুরে রাজনগর উপজেলায় পারভীন বেগমের (৫০) ভাসুরের ছেলে ওমান থেকে পারভীনের একাউন্টে টাকা পাঠান। জনতা ব্যাংকের রাজনগর শাখা থেকে ৫০ হাজার টাকা তোলেন তিনি। টাকা নিয়ে ব্যাংকের নিচে আসতেই এক ব্যক্তি পারভীন বেগমের টাকা ‘ফুঁ’ দিয়ে দ্বিগুণ করে দেওয়ার কথা বলে ৫০ হাজার টাকা নিয়ে যান।
প্রতারণার শিকার পারভীন বেগম জানান, ব্যাংক থেকে নামার পর তার সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন এক ব্যক্তি। এ সময় ওই ব্যক্তি তার আধ্যাত্মিকতার কথা বলে ‘ফুঁ’ দিয়ে টাকা দ্বিগুণ করে দেবেন বলে জানান। এভাবে তিনি অনেকের টাকা দ্বিগুণ করে দিয়েছেন বলে একটি ব্যাগ আনতে তাকে পাশের দোকানে পাঠান। সেখান থেকে আসার পর ব্যাগে টাকা মুড়িয়ে দিয়েছেন বুঝিয়ে তাকে বাড়ি চলে যেতে বলেন ওই প্রতারক। পরে বাজারের এক ফার্মেসিতে ওষুধ কিনতে গিয়ে পারভীন বেগম দেখেন তার ব্যাগে টাকা নেই।
জনতা ব্যাংকের নিচে অবস্থিত মুদি দোকানি সবুজ বলেন, প্রতারক চক্রের সদস্যরা খুবই কৌশলী। এদের সন্দেহ করা যায় না। এরা অভিনব পদ্ধতি নিয়ে কাজে নেমেছে। আমরা ব্যবসায়ীরা আতঙ্কে আছি। ব্যাংকের বিপরীত পাশের নিচ তলার একটা দোকানে লাগানো সিসি ক্যামেরা খুঁজে দেখা যায়, এক ব্যক্তির সাথে ওই মহিলার দীর্ঘ সময় কথা হয় এবং টাকা লেনদেন হতেও দেখা যায়। এ থেকে বুঝা যায় প্রতারকের প্রলোভনে পড়ে পারভীন বেগম টাকাগুলো তুলে দিয়েছেন।
৯ মার্চ বৃহস্পতিবার সকালে একই বাজারের সোনালী ব্যাংকের সামনে থেকে একই কায়দায় রাজনগর ইউনিয়নের দক্ষিণ খারপাড়া গ্রামের খেলা বেগমের ২৮ হাজার টাকা নিয়ে যায় এক প্রতারক।
পরপর দুটি ঘটনায় রাজনগরের ব্যবসায়ী ও ব্যাংকে যাতায়াতকারীদের মধ্যে আতংক বিরাজ করছে। তারা বলছেন, অভিনব প্রতারক চক্রের আবির্ভাব ঘটেছে মৌলভীবাজারের রাজনগরে। এদের প্রতারণা টের পাওয়া যায় না। তারা এ পর্যন্ত ৭৮ হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।
১৯ মার্চ রোববার, কামারচাক ইউনিয়নের আদমপুর গ্রামের রায়না বেগম সোনালি ব্যাংকের তারাপাশা বাজার শাখা থেকে টাকা নিয়ে বের হলে এক ব্যক্তি নিজেকে মাজারের খাদিম পরিচয় দিয়ে টাকা দ্বিগুণ করে দিবে বলে। কয়েকজন সহযোগী প্রতারক আশেপাশে ওৎ পেতে থাকে। এ সময় রায়নার কাছ থেকে ৫১ হাজার টাকা হাতিয়ে নেয় প্রতারক চক্র। এ ঘটনায় ওই নারী থানায় অভিযোগ দিলে পুলিশ তদন্তে নামে। কিন্তু সিসিটিভিতে প্রতারকদের চেহারা ও ব্যবহৃত গাড়ি স্পষ্ট না থাকায় বিপাকে পরে পুলিশ। শেষে গাড়ির সামনের গ্লাসে সাঁটানো একটি নির্বাচনী পোস্টারের সূত্র ধরে খোঁজ নেয়া শুরু হয়। পুলিশ জানতে পারে, শ্রীমঙ্গল-হবিগঞ্জ রোডের সিএনজি শ্রমিকদের নির্বাচন সম্প্রতি শেষ হয়েছে।
মঙ্গলবার দিবাগত রাত সাড়ে ১২টার দিকে রাজনগর থানার পুলিশ শ্রীমঙ্গল পৌরশহরের খাসগাঁও এলাকায় অভিযান চালিয়ে কমলগঞ্জের উত্তর বালিগাঁও গ্রামের মৃত মতি মিয়ার ছেলে প্রতারক চক্রের অন্যতম সদস্য সালাউদ্দিনকে (৪৩) অটোরিক্সাসহ আটক করা হয়। তার বিরুদ্ধে সিলেট ও মৌলভীবাজারের বিভিন্ন থানায় ১৩টি মামলা রয়েছে বলে জানায় পুলিশ।
পরে তার দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে ওই চক্রের সদস্য শ্রীমঙ্গলের আশিদ্রোন ইউনিয়নের মহাজিরাবাদ গ্রামের মৃত আব্দুল খালেকের ছেলে আব্দুল মুসলিম (৪২) ও শ্রীমঙ্গলের জালালিয়া রোড দক্ষিণের সিরাজ মিয়ার ছেলে আনোয়ার মিয়া ওরফে আয়নাকে আটক করা হয়।
প্রথমে তারা ঘটনার সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করলেও পরে সিসিটিভি ফুটেজ দেখালে তারা প্রতারণার সাথে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে। ওই রাতে তাদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে সহযোগীদের আটক করতে জেলার বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালানো হয় বলে পুলিশ জানায়।
এ ব্যাপারে রাজনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বিনয় ভূষণ রায় বলেন, ভুক্তভোগী এক নারীর অভিযোগের প্রেক্ষিতে আমরা তদন্ত শুরু করে আমরা প্রথমে সিএনজি চালককে আটক করি। পরে জিজ্ঞাসাবাদে সে তার অন্য সহযোগীদের নামও জানিয়েছে। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৩ জনকে আটক করা হয়েছে। বাকি আসামিদের আটক করতে অভিযান অব্যাহত আছে। আটক করা আসামিদের আদালতে পাঠানো হয়েছে।
আরও পড়ুন
অগ্নিকান্ডে মিঠাপুকুরের নয়ন একমাত্র উপার্জনকারীর মৃত্যুতে দিশেহারা পরিবার
সাবেক মন্ত্রী কায়কোবাদের সঙ্গে তুর্কী এমপির সাক্ষাৎ
মেঘনায় জাহাজে ৭ খুন: যেভাবে ধরা পড়ে ‘একমাত্র’ খুনি