এস এ শফি, সিলেট:
‘বাংলাদেশে একটি স্বাধীন গণতান্ত্রিক দেশ যার সংবিধানে মানুষের অধিকারের বিষয়গুলো পরিষ্কারভাবে লিপিবদ্ধ আছে। আমাদের সংবিধানের ২৬ থেকে শুরু করে ৪৭(ক) ধারায় নাগরিকদের মৌলিক অধিকারের বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়েছে। সংবিধানের আলোকে দেশে অনেক আইন, নীতিমালা ও সেবার ব্যবস্থা করা হয়েছে ঠিকই কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে এখনো আমরা প্রত্যাশিত অগ্রগতি অর্জন করতে পারিনি। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নারী, শিশু ও চা-শ্রমিকের অধিকার। স্বাধীনতার এত বছর পরও আমরা আমাদের নারী, শিশু ও চা-শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার ও নিরাপত্তার দিকগুলো নিশ্চিত করতে পারিনি। বরং সময় সময় কিছু সংবাদ আমাদের মানবাধিকার পরিস্থিতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।’ মঙ্গলবার (১০ ডিসেম্বর) সকাল সাড়ে ১১টায় এথনিক কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (একডো)-এর আয়োজনে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসে আলোচনা সভায় বক্তারা এসব কথা বলেন।
এর আগে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস উপলক্ষে সকাল সাড়ে ১০টায় র্যা লি করা হয়। র্যাডলি শেষে সিলেট নগরীর চাঁদনীঘাট এলাকায় সারদা হলে ‘আমাদের অধিকার, আমাদের ভবিষ্যৎ, এখনই’ এ প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে আলোচনা সভা করা হয়। সভা শেষে একডো আন্তর্জাতিক সহযোগী সংস্থা অক্সফাম ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সহযোগিতায় লিডারশিপ ডেভেলপমেন্ট অব টি গার্ডেন ওমেন ওয়ার্কার অন দেয়্যানর রাইটস্ প্রকল্পের আওতায় চা শ্রমিকদের জীবনযাত্রা নিয়ে নাটক ‘সবুজ বৃক্ষের নীল কষ্ট’ পরিবেশিত হয়।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম) মুঃ মাসুদ রানা, পিপিএম-সেবা। সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আবুল কাশেম উজ্জ্বল। আলোচক ছিলেন সিলেট জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট অশোক পুরকায়স্থ, সিলেট জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট এমাদ উল্লাহ শহিদুল ইসলাম, বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি, সিলেটের বিভাগীয় প্রধান ও সচেতন নাগরিক কমিটি, সিলেটের সভাপতি আ্যাডভোকেট সৈয়দা শিরিন আক্তার। এডকোর নির্বাহী পরিচালক লক্ষ্মীকান্ত সিংহের সভাপতিত্বে বিশেষ অতিথির বক্তব্য দেন সুজন সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী, ৬নং ইউপি চেয়ারম্যান আবুল কসেম চৌধুরী, অ্যডভোকেট মনির৷ উদ্দিন হেলাল, ৬নং ইউপি মেম্বার দিলিপ রঞ্জন কুর্মী।
সভায় বক্তারা বলেন, বাংলাদেশে বসবাসকারী ক্ষুদ্র ও বিশেষ জাতি-গোষ্ঠীর মধ্যে চা-শ্রমিকরা অন্যতম। তারা দেশের নাগরিক হওয়ার পরও বিশেষ পরিচয়ের কারণে যুগে যুগে তাদের প্রতি অবহেলা আর বৈষম্য হয়েছে এবং হচ্ছে। মজুরী, কর্ম পরিবেশ, শ্রম অধিকার, আবাসনসহ বহুবিদ উপায়ে তাদের প্রতি সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় বৈষম্য অবসান হচ্ছে না। আইন ও বিধি থাকার পরও অনেক কারণে তারা তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সময় সময় তারা প্রতিবাদ করেছে কিন্তু পরিবর্তন হয়েছে খুব কমই।
সভায় জানানো হয়, ২০১৮ সালে একজন চা শ্রমিক দিনে সর্বোচ্চ ১২০ টাকা মজুরি পেতেন। ২০২১ সালে চা শ্রমিক ইউনিয়নের সঙ্গে বাংলাদেশ চা-সংসদের (বাগান মালিকদের সংগঠন) এক চুক্তি হয় যেখানে মজুরি বাড়িয়ে ৩০০ টাকা করা হয়েছিল। কিন্তু চুক্তিটি বাস্তবায়ন না হওয়ায় চা শ্রমিকরা ২০২২ সালে ধর্মঘটের ডাক দিলে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে প্রথম শ্রেণির বাগানের একজন শ্রমিকের দিনে ১৭০, দ্বিতীয় শ্রেণির বাগানের শ্রমিকের ১৬৯ ও তৃতীয় শ্রেণির বাগানের শ্রমিকের ১৬৮ টাকা মজুরি নির্ধারিত হয়। এই মজুরি বাস্তবতার তুলনায় অত্যন্ত কম। নিম্ন মজুরি এবং অমানবিক জীবন-যাপনের কারণে যক্ষা, কুষ্ঠ, ম্যালেরিয়া ও জরায়ু ক্যান্সারের প্রবণতা চা শ্রমিকদের মধ্যে বেশি। সিলেট ও মৌলভীবাজার জেলায় প্রতি বছর যে পরিমাণ যক্ষা রোগী শনাক্ত হয়, তার ৩৬ শতাংশই চা বাগানের জনগোষ্ঠী। কুষ্ঠ রোগের চিত্র আরও ভয়াবহ। গত চার বছরে মৌলভীবাজারে ৭৬১ কুষ্ঠ রোগীর মধ্যে ৬৩১ জনই চা বাগানের বাসিন্দা। ২০১৯ সালে সিলেট অঞ্চলের চা বাগানগুলোর স্বাস্থ্য পরিস্থিতি নিয়ে জরিপ করে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। জরিপে দেখা যায়, অপুষ্টির কারণে চা বাগানের ৪৫ শতাংশ শিশুই খর্বকায়। ২৭ শতাংশ শীর্ণকায়। স্বল্প ওজনের শিশু ৪৭.৫ শতাংশ। তা ছাড়া ১৮ বছরের আগে বিয়ে হয়ে যায় ৪৬ শতাংশ কিশোরীর এবং তাদের মধ্যে মা হয় ২২ শতাংশ। এ ছাড়া ন্যূনতম স্যানিটেশন সুবিধা নেই ৬৭ শতাংশ পরিবারের। একই অবস্থা শিক্ষা, রাজনৈতিক অংশগ্রহণ, বিনোদনসহ অন্যান্য মৌলিক ক্ষেত্রে। ফলে তাদের অধিকারের বিষয়টি এখন সময়ের দাবী। তাদের প্রতি যে বৈষম্য হচ্ছে এর অবসান হওয়া অতীব জরুরী।
আরও পড়ুন
সাংবাদিকদের সাথে রংপুর পুলিশ সুপারের মতবিনিময়
আশুলিয়ায় মরদেহ পোড়ানোর মামলায় কনস্টেবল মুকুল কারাগারে
শীতে শিশুদের সুস্থ রাখবে যেসব খাবার