June 25, 2025

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Tuesday, June 24th, 2025, 7:31 pm

সিলেটে ঝুঁকিপূর্ণ টিলায় বাস করছেন ১০ হাজার মানুষ:৫ বছরে ২০ জনের মৃত্যু

বৃষ্টিতে পাহাড়-টিলা ধসের মধ্যেও সিলেটের বিভিন্ন এলাকায় ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করছেন ১০ হাজারেরও বেশি মানুষ। জেলায় পাঁচ বছরে টিলা ধসে প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ২০ জন। এরপরও কমছে না ঝুঁকিপূর্ণ বসতি স্থাপন। টিলায় বসবাস নিরুৎসাহিত করতে বিদ্যুৎ-গ্যাস সংযোগ বন্ধ করেছে জেলা প্রশাসন।
গত পহেলা জুন সিলেটের গোলাপগঞ্জে টিলা ধসে প্রাণ হারান একই পরিবারের ৪ জন। গত বছরও জুনে এভাবে নগরীর চামেলীবাগে মৃত্যু হয় স্বামী-স্ত্রী ও সন্তানের। গত ৫ বছরে টিলা ধসে এই এলাকায় প্রাণহানি অন্তত ২০ জনের। প্রতিবছর টিলা ধসে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়লেও, বন্ধ হয়নি পাহাড় কেটে বাড়ি-ঘর তৈরি। বরং ঝুঁকির মধ্যেও বাড়ছে বসবাসকারীদের সংখ্যা।
পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো বলছে, দুর্ঘটনা ঘটলেই নড়েচড়ে বসে প্রশাসন। এছাড়া সারাবছর তাদের তৎপরতা দেখা যায় না।
গত দেড় দশকে সিলেটে অন্তত ৬১টি টিলা কেটে ফেলা হয়েছে। জেলার ৪১২টি পাহাড়-টিলার মধ্যে টিকে আছে মাত্র ৩৫১টি।
জেলা ত্রাণ ও পূণর্বাসন কেন্দ্র সিলেটের তথ্যমতে, জেলার মধ্যে ৩৮৬টি পরিবারের এখনো বসবাস টিলার পাদদেশে মৃত্যুকূপে। যে কারণে প্রতি বছরই ঘটছে ‍দুর্ঘটনা। আর অঘটন ঘটলেই কেবল সতর্কতার হাকডাক পড়ে যায়। এমনি ঘটেছে এবারো সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার লক্ষনাবন্দ ইউনিয়নে টিলা ধসে চার মুত্যুর পর।
জানা গেছে, মৃত্যুকূপে বসবাসকারীরা বৃষ্টি এলেই টিলার পাশে দিনযাপন করলেও রাত্রি কাটান অন্যের ঘরে। তাদের ধারণা দিনে টিলা ধসে পড়বে না, কিংবা দ্রুত ঘটনাস্থল ত্যাগ করতে পারবেন। বড়দের এই চিন্তাধারা থাকলেও ঝুঁকিতে থেকে ছোট ছোট শিশু ও বৃদ্ধরা।
সিলেটে পাহাড় ও টিলা ধসে অহরহ মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। প্রতিবছর টিলা ধসে নিহত হচ্ছেন তবু টিলার পাদেদেশে ঝুঁকিতে বসবাস থামছে না। এ ব্যাপারে প্রশাসনের ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ।
সিলেটে কি পরিমাণ লোকজন পাহাড়-টিলার পাদদেশে বসবাস করেন, সরকারিভাবে এর কোনো তালিকা নেই। কেবল পরিবারের হিসাব রয়েছে।
জানা গেছে, প্রভাবশালীচক্র টিলা কাটা বা দখলে রাখার জন্য টিলার পাদদেশে ঘর-বাড়ি বানিয়ে ভূমিহীনদের কম ভাড়ায় রাখেন। কম ভাড়া পেয়ে খুশিতে মৃত্যুকূপে বসবাস করেন অনেক পরিবার। পাশাপাশি টিলা কেটে ঘরবাড়ি নির্মাণ ও শ্রেনী পরিবর্তন করা হচ্ছে। ফলে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। টানা বৃষ্টি হলেই সিলেটে পাহাড়-টিলা ধসের খবর পাওয়া যায়। এসব ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়-টিলার পাদদেশে ৩৮৬টি পরিবার ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় বসবাস করলেও তাদের সরিয়ে নেওয়ার কোনো উদ্যোগ আজো পরিলক্ষিত হয়নি।
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্র সিলেটের তথ্য অনুযায়ী, সিলেটে ২৭৯টি পাহাড়-টিলার মধ্যে ১৬৯টি ঝুঁকিপূর্ণ রয়েছে। এরমধ্যে সিলেটের গোলাপগঞ্জ পৌর এলাকায় ৫ টিলার পাদদেশে ৭টি পরিবার, উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে ৭১টি টিলা ঘেষে ৮৮টি পরিবার, বিয়ানীবাজার উপজেলায় ৯টি টিলায় ৯টি পরিবার, কানাইঘাট উপজেলায় ১টি টিলায় ৩টি পরিবার, কানাইঘাট উপজেলার মোট ৭৫টি টিলার মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ ১টি টিলায় ৩টি পরিবার বসবাস করছে, ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার ঘিলাছড়া ইউনিয়নের ১২টি টিলায় ৩৮টি পরিবার বসবাস করছে, বিশ্বনাথ উপজেলার ১টি টিলায় ৬টি পরিবার ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করছেন, সিলেট সদর উপজেলার খাদিমনগরে ২৫টি টিলায় মোট ৭০টি পরিবার, খাদিমপাড়ায় ১৫টি টিলায় মোট ৩৯টি পরিবার, টুকেরবাজার ২০টি টিলায় ১২৫টি পরিবার ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করছেন।
অবশ্য সিলেটের জকিগঞ্জে ৯টি টিলা, গোয়াইনঘাটের পূর্ব জাফলংয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ১টি টিলাসহ মোট ২৭টি টিলা রয়েছে। এগুলোতে জনবসতি নেই বলেও জানা গেছে।
সিলেটে প্রতি বছর ভারী বৃষ্টিপাতে বিভিন্ন টিলা-পাহাড়ের মাটি নরম হয়ে যায় এবং মাটি ধসে ছোট-বড় নান দুর্ঘটনা ঘটে মাঝেমধ্যে বড় ধরনের ট্র্যাজেডির সৃষ্টি হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ১০ বছরে সিলেট বিভাগে টিলার মাটি ধসে অন্ততঃ অর্ধশতাধিক প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে।  ঘটনাগুলোর জন্য টিলা-পাহাড় কর্তনকেই মূলতঃ দায়ী করছেন পরিবেশবাদী ও বিশেষজ্ঞরা। এরপরও সিলেটে কিছুতেই বন্ধ হয় না পাহাড়-টিলা কাটা।
সর্বশেষ শনিবার (১ জুন) সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলায় ভারী বৃষ্টিতে টিলা ধসে পড়ে এক পরিবারের চারজন নিহত হয়েছেন।
গতবছরের ১০ জুন সিলেট মহানগরীর মেজরটিলার চামেলীভাগ আবাসিক এলাকায় টিলা টিলা ধসে মাটি চাপা পড়ে একই পরিবারের তিন সদস্য নিহত হন। এতে আহত হন আরও তিনজন। নিহতরা হলেন- আগা করিম উদ্দিন (৩১), তার স্ত্রী শাম্মী আক্তার রুজি (২৫) ও তাদের শিশু সন্তান নাফজি তানিম । একই স্থানে টিলা ধসে ১৯৯৭ সালে প্রাণ হারিয়েছিলেন হুনদা নামের এক যুবক।
এদিকে, প্রতি বর্ষা মৌসুমে সিলেট জেলায় টিলা-পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটলেও এগুলোর পাদদেশে ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করেন মানুষজন। ফলে প্রতি বছরই সিলেটে ঘটে টিলা বা পাহাড় ধসে মৃত্যুর ঘটনা। মহানগরীসহ সিলেট জেলার বিভিন্ন স্থানে পাহাড়-টিলায় কয়েক বছর আগেও মানুষের তেমন আনাগোনা ছিলোনা কিন্তু এখন এই সকল সেসব এলাকায় গড়ে উঠেছে ঘনবসতি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সিলেট নগরীর হাওলাদারপাড়া, আখালিয়া, পীরমহল্লা ব্রাহ্মণশাসন জাহাঙ্গীরনগর, তারাপুর চা বাগান এবং নগরীর উপকণ্ঠের বালুচর, বিমানব›র সড়ক, খাদিমপাড়া, খাদিমনগর, জোনাকী, ইসলামপুর মেজরটিলা, মংলিরপাড় এলাকায় বিভিন্ন টিলার পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করছে কয়েক শ’ পরিবার। এছাড়া জৈন্তাপুর, গোলাপগঞ্জ, বিয়ানীবাজার, গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় টিলা ও পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে কয়েক হাজার মানুষজন।
সিলেট মহানগরীর ৬নং টুকেরবাজারের জাহাঙ্গীরনগর এলাকায় কয়েকজনের সাথে কথা হলে তারা বলেন, বৃষ্টিতে টিলার পাদদেশে দিনে বসবাস করলেও রাতে পরিবার-পরিজন নিয়ে আত্মীয়স্বজনের বাসায় চলে যান। ছোট ছোট শিশু ও বৃদ্ধরাও এই মৃত্যু ঝুঁকিতে দিন পার করছেন। বর্ষা মৌসুম আসার আগে কিংবা কোনো দুর্ঘটনার আশঙ্কা থাকলেও প্রসাশনের পক্ষ থেকে নির্দেশনা দেয়া হয় না। যেকোনো দুর্ঘটনা ঘটার পর প্রসাশন থেকে মাইকিং করা হয় কিন্তু বর্ষা মৌসুম আসার আগে কোনো ধরনের নির্শেনা কিংবা কোনো ধরনের ঝুঁকি সম্বলিত বিলবোর্ড টানানো হয় না।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম কিম বলেন, ‘সিলেটে নির্বিচারে পাহাড় টিলা কাটা হয়। পাহাড় কাটার কৌশল হিসেবে পাহাড়ের পাদেশে নিম্নআয়ের মানুষের জন্য বসতি বানানো হয়। ঝুঁকি নিয়ে কয়েক হাজার মানুষ বাস করেন এসব পাহাড়-টিলার আশপাশে। ফলে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পাহাড় বা টিলাধসে একাধিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে।’
পরিবেশবাদী সংগঠন সেভ দ্যা হেরিটেজ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট’র প্রধান সমন্বয়ক আবদুল হাই বলেন, ‘আমরা বছর তিনেক আগে একটা জরিপ চালিয়ে দেখেছিলাম জেলায় টিলার পাদদেশে প্রায় ১০ হাজার পরিবার ঝুঁকিপূর্ণভাবে বাস করছেন। এখন এই সংখ্যা আরও অনেক বাড়বে। বসবাসের জন্য এসব টিলার অনেকাংশ কেটে ফেলায় টিলাগুলোও দুর্বল হয়ে পড়েছে। ফলে বর্ষা মৌসুমে এগুলো ধসে পড়ে প্রাণহাণির ঘটনা ঘটে। অপরিকল্পিতভাবে টিলা কাটা, বৃক্ষ উজার ও টিলার পাদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসের ফলে বৃষ্টি হলেই টিলা ধসে পড়ছে বলে মত এই পরিবেশকর্মীর।’
সিলেটের জেলা প্রশাসক শের মাহবুব মুরাদ বলেন, ‘টিলা কাটার ব্যাপারে আমাদের অভিযান অব্যহত আছে। প্রত্যক উপজেলাতেই টিলা কাটা হয়ে থাকে। প্রতি মাসেই এ অভিযান পরিচালনা করা হয়ে থাকে। আমরা মানুষকে বিরত রাখার চেষ্টা করছি। এর কারণে যারা ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় থাকে তাদের কোনোভাবেই যেন ইউটিলিটি না দেওয়া হয়। যেমন: বিদ্যুৎ, পানির সরবরাহ না করা হয়।