সিলেট অফিস :
আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতির সময়েও সিলেটে মাতৃগর্ভে শিশু মৃত্যুর হার বেড়েই চলেছে। শুধুমাত্র সরকারি হিসেবেই তিন বছরে দুই হাজারেরও বেশি শিশুর মৃত্যু হয়েছে মায়ের গর্ভেই। এর বাইরে অনেক মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে, যা সরকারের হিসেবে নেই।
চিকিৎসকরা বলছেন, মাতৃগর্ভে শিশু মৃত্যুর ২৫-৩৫ শতাংশ কারণ এখনও অজানা। জন্মের আগে শিশু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার সুযোগ না থাকায় মৃত্যুর সঠিক কারণ উদঘাটন করা সম্ভব হয় না। তবে যেসব কারণে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে তার মধ্যে অন্যতম হলো-যোগাযোগ ব্যবস্থার অপ্রতুলতা, দুর্গম এলাকা ও অসচেতনতা। এছাড়াও দারিদ্র-কুসংস্কার ও শিক্ষার অভাবেও এমন ঘটনা ঘটছে বলছেন চিকিৎসকরা।
স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্যমতে, গত তিন বছরে সিলেটে মাতৃগর্ভে দুই হাজারেরও বেশি শিশুর মৃত্যু ঘটেছে। বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকা ও দুর্গম উপজেলা—বিয়ানীবাজার, কানাইঘাট ও কোম্পানীগঞ্জ—এ এই হার সবচেয়ে বেশি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসব এলাকায় দুর্বল যোগাযোগ ব্যবস্থা, শিক্ষার অভাব, স্বাস্থ্য সচেতনতার ঘাটতি এবং কিছু কুসংস্কার মাতৃগর্ভে শিশু মৃত্যুর কারণ হিসেবে বড় ভূমিকা রাখছে।
সিলেট সিভিল সার্জন অফিসের এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০২২ সালে মাতৃগর্ভে মারা যাওয়া ৫৭০ শিশুর মধ্যে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৩৬৪ জন ও বিভিন্ন উপজেলা হাসপাতালে ২০৬ জন।
২০২৩ সালে মারা যাওয়া ৭৪০ জন শিশুর মধ্যে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৫৮৩ জন, খাদিমপাড়া হাসপাতালে ৭ জন ও বিভিন্ন উপজেলা হাসপাতালে ১৫০ জন।
তাছাড়া ২০২৪ সালে সিলেটে মাতৃগর্ভে ৭৩২ শিশুর মৃত্যুর হিসাব পাওয়া গেছে। এরমধ্যে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৫৮৩ জন, খাদিমপাড়া হাসপাতালে ১৫ জন ও বিভিন্ন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আরও ১৫০ জন শিশু মায়ের গর্ভেই মারা গেছে।
এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০২২ সালে সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলায় ৮৬ জন, কানাইঘাট উপজেলায় ৫৩ জন, জৈন্তাপুর উপজেলায় ২৭ জন ও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় ১৬ শিশুর মাতৃগর্ভে মৃত্যু হয়েছে। ২০২৩ সালে বিয়ানীবাজার উপজেলায় ৩৭ জন, কানাইঘাট উপজেলায় ২৩ জন, জৈন্তাপুর উপজেলায় ১৬ জন ও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় ২১ জন; এছাড়া ২০২৪ সালে বিয়ানীবাজার উপজেলায় ২৭ জন, কানাইঘাট উপজেলায় ৩১ জন, জৈন্তাপুর উপজেলায় ১০ জন ও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় ২৫ জন শিশুর মাতৃগর্ভে মৃত্যু হয়েছে।
চিকিৎসকরা বলছেন, মাতৃগর্ভে ২৫ থেকে ৩৫ শতাংশ শিশুর মৃত্যুর কারণ এখনও অজানা। মৃত শিশুর রিপোর্ট তৈরি বা অনুসন্ধান করলেও মৃত্যুর সঠিক কারণ পাওয়া যায় না। আর যেসব কারণ শনাক্ত করা যায় তার বেশিরভাগ অংশই মায়ের সমস্যাজনিত। মায়েদের সমস্যার মধ্যে অসচেতনতা-অপুষ্টি ও অপরিকল্পিত গর্ভধারণ। এর বাইরে রয়েছে অজ্ঞতা-অশিক্ষা ও কুসংস্কার। এ অবস্থায় মাতৃগর্ভে শিশু মৃত্যুর হার কমাতে মায়েদের স্বাস্থ্য সচেতনতার পাশাপাশি ‘প্রি-কনসেপশন’ ও ‘ডিউরিং প্রেগনেন্সি’ এই দুই বিষয়ে গুরুত্ব দিতে বলছেন চিকিৎসকরা।
সিলেটের গাইনি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অধ্যাপক রাশিদা আখতার জানান, ‘মাতৃগর্ভে মারা যাওয়া শিশুদের মধ্যে ২৫ থেকে ৩৫ শতাংশেরই কোনো কারণ শনাক্ত করা যায় না। মৃত শিশুর জন্মের পর রিপোর্ট তৈরি করলে বা ইনভেস্টিগেশন করলে কোনো কারণ পাওয়া যায় না। তবে মায়ের পরীক্ষা নিরীক্ষা করলে অনেকগুলো কারণ পাওয়া যায়।’
তিনি বলেন, ‘মায়ের সমস্যা, শিশুর সমস্যা ও গর্ভফুলের সমস্যার কারণে গর্ভে শিশু মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। তাছাড়াও কিছু পারিপার্শ্বিক কারণ থাকে। গর্ভে শিশুর মৃত্যুর জন্য মায়ের যে কারণগুলো পাওয়া যায় তারমধ্যে অন্যতম হলো- মায়ের উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, গর্ভে ইনফেকশন, অতিরিক্ত জ্বর এবং রক্ত-প্রস্রাবের ইনফেকশন।’
তাছাড়া ডেলিভারির জন্য অপেক্ষা, অনিয়মিত ওষুধ সেবন, ভুল ওষুধ সেবন ও ‘আরলি প্রেগন্যান্সি’ এসবের কারণেও গর্ভে সন্তানা মারা যেতে পারে বলে জানান অধ্যাপক রাশিদা।
ডা. রাশিদা আখতার আরও বলেন, ‘অনেক সময় মাল্টিপল প্রেগন্যান্সির কারণেও বাচ্চার বিকলাঙ্গতা দেখা দেয়। তাছাড়াও স্বামী-স্ত্রীর ব্লাড গ্রুপের কারণেও গর্ভে শিশু মারা যায়। যেমন বাবার রক্তের গ্রুপ নেগেটিভ ও মায়ের পজিটিভ। এসব কারণেও অনেক সময় গর্ভে সন্তান মারা যেতে পারে।’
ডা. রাশিদা বলেন, ‘অনেক সময় শিশুর বিকলাঙ্গতা, গর্ভে ইনফেকশন, পেটে শিশুর অবস্থান, অতিরিক্ত রক্তপাত হওয়ার কারণে মায়ের গর্ভেই শিশুর মৃত্যু হয়ে থাকে। অনেক সময় নাড়ি বাচ্চার গলায় পেঁচিয়ে যাওয়ার কারণে মৃত্যু হয়। আবার জেনেটিক কিছু কারণেও মাতৃগর্ভে শিশুর মৃত্যু হয়।’
ডা. রাশিদা আরও বলেন, যখন এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটে তখন আমরা মায়ের পরীক্ষা নিরীক্ষা করে থাকি। পরবর্তীতে যাতে এ ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হতে না হয়, সেজন্য মাকে কিছু নিয়ম মেনে চলার কথা বলা হয়। তবে মাতৃগর্ভে শিশু মৃত্যুর হার কমাতে ‘প্রি-কনসেপশন’ ও ‘ডিউরিং প্রেগন্যান্সি’ এই দুই বিষয়কে গুরুত্ব দিতে বলেন এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক।
কানাইঘাট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক চিকিৎসক ডা. ইরফানুল হক জানান, দূরবর্তী ও দুর্গম এলাকার মা-শিশুদের হাসপাতালে সময়মতো পৌঁছানোর সুযোগ কম। অনেকেই অদক্ষ দাইয়ের মাধ্যমে বাড়িতেই প্রসবের চেষ্টা করেন। ফলে শিশুর মৃত্যু হয়। একই সঙ্গে মায়েদের অসচেতনতা ও পুষ্টিহীনতাও ঝুঁকি বাড়ায়।
এদিকে গত তিন বছরে সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলায় ১৫০ জন শিশুর মাতৃগর্ভে মৃত্যু হয়েছে। এর বাইরে বাসা-বাড়িতেও অনেক মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা ও চিকিৎসা ব্যবস্থা সহজতর হওয়া সত্ত্বেও বিয়ানীবাজারে এতো মৃত্যুর কারণ জানা নেই কারো।
সংশ্লিষ্টরা মৃত্যুর পরিসংখ্যান নিয়ে প্রশ্ন তুললে চিকিৎসকরা বলেন, অন্যান্য উপজেলার মতো বিয়ানীবাজারেও মৃত্যু কমছে। কিন্তু মায়ের অসচেতনতা-পুষ্টিহীনতা ও চিকিৎসক সংকটের কারণে অনেক মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে।
বিয়ানীবাজার উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা আবুল মনসুর আমজাদ বলেন, ‘গ্রামে স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য আমরা নিয়মিত ক্যাম্পেইন চালাই। তবুও প্রচলিত কুসংস্কার এবং অজ্ঞতার কারণে মাতৃগর্ভে শিশু মৃত্যুর ঘটনা কমানো যাচ্ছে না। জনবল সংকট ও চিকিৎসক অভাবও এ সমস্যাকে জটিল করছে।‘
আরও পড়ুন
মুরাদনগরে মোটরসাইকেল আরোহীকে মারধর, ২ যুবক গ্রেপ্তার
নাটোরে বিদেশি মদ ও ইয়াবাসহ আটক ২
গঙ্গাচড়ায় সরকারিভাবে গ্রাম পুলিশের মাঝে বাইসাইকেল ও ছাতা বিতরণ