জেলা প্রতিনিধি, সিলেট :
শতবছরের ভয়াবহ বন্যায় সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলায় মানবিক বিপর্যয় ঘটেছে। ঘরে ঘরে এখন হাহাকার। পানিতেই ভাসছে মানুষ, কিন্তু খাওয়ার জন্য এক ফোঁটা পানি নেই। নলকূপসহ সুপেয় পানির সব উৎস বন্যায় নষ্ট হয়ে গেছে। বাধ্য হয়ে বন্যার নোংরা পানিই পান করছেন অনেকে। খাবার সংকট দিনে দিনে তীব্র হচ্ছে। ঘরে থাকা শুকনো খাবার শেষ হয়ে গেছে। এখন শুধুই ত্রাণের অপেক্ষা। সরকারি ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে ত্রাণ বিতরণ অব্যাহত থাকলেও তা চাহিদার তুলনায় সামান্যই।
এদিকে সিলেটের আরেক জেলা হবিগঞ্জে বন্যার বিস্তৃতি বাড়ছে। রোববার পর্যন্ত জেলার ১০০ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। অন্য জেলা মৌলভীবাজারে তলিয়ে গেছে ৩০০ গ্রাম।
প্রশাসনের কর্মকর্তারাও বলছেন, সিলেট ও সুনামগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ। লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দি। তাদের উদ্ধার ও পর্যাপ্ত খাবার পৌঁছে দেওয়া সত্যিই কঠিন চ্যালেঞ্জ।
সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. মজিবর রহমান জানিয়েছেন, জলযান সংকটের কারণে অনেক এলাকায় উদ্ধারকাজ ও ত্রাণ বিতরণ ব্যাহত হচ্ছে। ভয়াবহ এ দুর্যোগ মোকাবিলায় সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী এবং বিজিবিসহ সরকারের সব সংস্থা সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল এসএম শফিউদ্দিন আহমেদ রোববার সিলেটে বন্যাদুর্গত এলাকা পরিদর্শন ও ত্রাণ বিতরণ করেছেন। মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সিলেটে আসবেন বলে জানিয়েছেন সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার ড. মুহম্মদ মোশাররফ হোসেন।
সিলেট নগরীর কিছু এলাকায় গতকাল পানি কিছুটা কমলেও বেশিরভাগ এলাকা এখনো প্লাবিত। এসব বাসাবাড়ির লোকজন অবর্ণনীয় দুর্ভোগে রয়েছে। অনেকে নগরীর আশ্রয়কেন্দ্রে গিয়ে উঠলেও সেখানে গাদাগাদি করে দুর্বিষহ সময় কাটছে। আছে খাবারের সংকটও।
জেলার সীমান্তবর্তী কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর, কানাইঘাট, জকিগঞ্জ উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ। এছাড়া সিলেট সদর, বিশ্বনাথ, বালাগঞ্জ, গোলাপগঞ্জ, ফেঞ্চুগঞ্জসহ সব উপজেলাই এখন বন্যাকবলিত।
কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার বিলাজুর গ্রামের এরশাদ মিয়া, আবদুল কাইয়ুম বলেন, ‘আমাদের ঘরবাড়ি এখনো পানিতে ডুবে আছে। পরিবার নিয়ে খুব কষ্টে দিন যাচ্ছে, যা ছিল সবকিছু ভেসে গেছে। না খেয়েই দিন পার করছি। সাহায্য-সহযোগিতা নিয়ে কেউ আসছে না।’ গত ১০০ বছরেও এত পানি এলাকার কেউ দেখেনি বলে তারা জানান।
কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার বর্নি, তেলিখাল, বিলাজুর, আঙ্গুরাকান্দি গ্রামের লোকজন জানিয়েছেন, রোববার পর্যন্ত তাদের গ্রামগুলোতে কোনো প্রকার ত্রাণ সহায়তা দেওয়া হয়নি। অনেকেই পরিবার-পরিজন নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে রয়েছে কয়েক দিন ধরে। বন্যায় শেষ হয়ে গেছে তাদের ঘরবাড়ি, ধান, গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগি। অনেকের ঘরবাড়ি রয়েছে পানির নিচে। পানি কমার সঙ্গে সঙ্গে এসব ঘরবাড়ি ভেঙে পড়বে বলে তারা জানান। তখন শূন্য ভিটায় তাদের ফিরতে হবে। কোম্পানীগঞ্জের এসব এলাকা রবিবার পরিদর্শন করেছেন সেনাপ্রধান এবং সেখানে ত্রাণও বিতরণ করেছেন।
সুনামগঞ্জ পৌরশহর এখনো ৪ থেকে ৬ ফুট পানির নিচে। সুনামগঞ্জ জেলার প্রায় শতভাগ এলাকাই বন্যায় বিপর্যস্ত। চার দিন ধরে সারা দেশের সঙ্গে সুনামগঞ্জের সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। বিদ্যুৎ নেই, মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্কও কাজ করছে না। সুনামগঞ্জে হাসপাতাল, দোকানপাট, অফিস-আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ব্যাংক সব জায়গায় পানি আর পানি। নৌকা ছাড়া যাতায়াতের নেই কোনো সুযোগ। খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাচ্ছে বানভাসি মানুষ।
সিলেট ও সুনামগঞ্জের বন্যাদুর্গত মানুষ জানিয়েছে, বানের পানি তাদের নিঃস্ব করে দিয়েছে। না খেয়েই তাদের দিন যাচ্ছে। মানবিক বিপর্যয় তৈরি হয়েছে দুর্গত এলাকায়। দুর্গত এলাকার বেশিরভাগ মানুষই দাবি করছে, তারা কোনো ধরনের ত্রাণ সহায়তা পাচ্ছে না। কেউ খোঁজও নিচ্ছে না।
জৈন্তাপুর উপজেলার হরিপুর গ্রামের আবুল হোসেন জানান, তিন দিন ধরে তার ঘরে পানি। পরিবারের নারী-শিশুদের অন্যত্র পাঠিয়ে দিয়েছেন। ঘরের মধ্যে মাচা তৈরি করে সেখানে ধান তুলে রেখেছেন। পানি আর কয়েক ইঞ্চি বাড়লেই ধানও ভিজে যাবে। তবে রোববার বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় পানি আর বাড়েনি। কিছু এলাকায় পানি কমছে বলেও জানান তিনি।
এদিকে সিলেট নগরীর সোবহানীঘাট, যতরপুর, উপশহর, মেন্দিবাগ, শিবগঞ্জ, মেজরটিলা, সাদাটিকর, তেরোরতন, মাছিমপুর, ছড়ারপাড়, কালীঘাট, তালতলা, জামতলা, মাছুদীঘিরপাড়, লামাপাড়, বেতেরবাজার, ঘাসিটুলা, বাগবাড়ি, শেখঘাট, টিকরপাড়া, কুয়ারপার, কাজিরবাজারসহ বিভিন্ন এলাকার রাস্তাঘাট, বাসাবাড়ি ও দোকানপাটে এখনো বন্যার পানি। সিলেট জেলা শহরের সঙ্গে সদর, গোয়াইনঘাট, কানাইঘাট, জৈন্তাপুর, কোম্পানীগঞ্জ ও জকিগঞ্জ উপজেলার সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। প্লাবিত এলাকার একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সরকারি-বেসরকারি কার্যালয়ের ভেতরে ঢুকে পড়েছে পানি। এর আগে গত ১৫ মে থেকে সিলেট নগরী ও ১৩টি উপজেলায় টানা বৃষ্টিপাত ও পাহাড়ি ঢলে বন্যা হয়েছিল। ওই বন্যায় প্রায় এক হাজার কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে জানায় জেলা প্রশাসন।
আরও পড়ুন
মন্ত্রিপরিষদ সচিবসহ শীর্ষস্থানীয় সাবেক ৭ সচিব হত্যা মামলার আসামি
ডেঙ্গুতে এক দিনে আরও ৫ জনের মৃত্যু
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য সচিব আবুল কালাম আজাদ গ্রেপ্তার