নিজস্ব প্রতিবেদক:
মারাত্মক ঝুঁকিতে রয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর। বন্দরের বিভিন্ন শেডে বিপজ্জনক রাসায়নিক পণ্যের স্তূপে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। যে কোনো সময় ঘটতে পারে ভয়াবহ বিপর্যয়। চট্টগ্রাম বন্দরের বিভিন্ন শেডে প্রায় ৪ হাজার টন পণ্য ও বিভিন্ন ইয়ার্ডে প্রায় পাঁচ হাজার কনটেইনার জমেছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বিপজ্জনক পণ্য রয়েছে। যা বন্দরের বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি ছাড়াও অপারেশনাল কার্যক্রমও বাধাগ্রস্ত করছে। চট্টগ্রাম বন্দরের ১৪টি শেডের মধ্যে মূলত পি শেডে বিপজ্জনক পণ্য রাখা হয়। প্রায় ৩০ হাজার ৩৭৫ বর্গফুট আয়তনের ওই শেড থেকেই পণ্য সরাসরি খালাস দেয়া হয়। তাছাড়া বন্দরের কনটেইনার রাখার চত্বরগুলোতেও ক্যাটাগরি অনুযায়ী বিপজ্জনক পণ্যবাহী কনটেইনার রাখা হয়। হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড, হাইড্রোক্লোরাইড, সালফেট, কস্টিক সোডা, ফার্মাসিউটিক্যালসের কাঁচামাল, রঙ তৈরির কাঁচামাল, টেক্সটাইল কেমিক্যাল, পারফিউমারি, ফিক্সিট সিলিকন, এস্ট্রোজেন, সারফেস অ্যাক্টিভ ক্লিনিং প্রভৃতি পণ্যের বেশির ভাগই দাহ্য ও বিস্ফোরকজাতীয় পদার্থ। অথচ পি শেডে সব ধরনের দাহ্য ও অদাহ্য পদার্থ একত্রে ঠাসাঠাসি করে রাখার ক্ষেত্রে কোনো প্রকার রাসায়নিক শ্রেণী বিভাগ করা হয়নি। আর চট্টগ্রাম বন্দরকে ব্যবহার করেই দেশের শতকরা ৯৮ ভাগ দ্রব্য আমদানি হয়ে থাকে। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, দীর্ঘদিনের পুরনো রাসায়নিক পণ্য চট্টগ্রাম বন্দরের বিভিন্ন শেড ও ইয়ার্ডে জমে রয়েছে। তার মধ্যে বিপজ্জনক পণ্যবাহী কনটেননারও আছে। চিহ্নিত ওসব বিপজ্জনক পণ্য দেশের প্রধান সমুদ্র বন্দরটির জন্য যে কোনো সময়ে বড় বিপদের কারণ হয়ে উঠার আশঙ্কা রয়েছে। তাছাড়া বিপজ্জনক পণ্য চিহ্নিত করতে না পারা চট্টগ্রাম বন্দরের জন্য আরেকটি বড় ঝুঁকি তৈরি করছে। কারণ অনেক ক্ষেত্রেই আমদানি হওয়া রাসায়নিক পণ্যের গায়ে মূল উপাদানের নাম না লিখে কেবল ওই দ্রব্য্য কী কাজে ব্যবহার হবে তা লেখা থাকে। ফলে লেবেল না থাকায় সব ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ রাসায়নিক দ্রব্য বন্দরে চিহ্নিত করা সম্ভব হয় না। তাতে মজুদের ক্ষেত্রে আলাদাভাবে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতে না পারায় বিস্ফোরণের ঝুঁকি বাড়ছে।
সূত্র জানায়, বন্দরের বিভিন্ন শেড ও ইয়ার্ডে পড়ে থাকা পণ্য ধ্বংস কিংবা নিলামে বিক্রির দায়িত্ব মূলত শুল্ক বিভাগের ওপর ন্যস্ত। আর শুল্ক বিভাগকে বন্দরের অভ্যন্তরে পড়ে থাকা ওই ধরনের পণ্যের ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে নিয়মিত অনুরোধ জানানো হচ্ছে। কিন্তু শুল্ক বিভাগ বিভিন্ন সময়ে কিছু কিছু পণ্য ধ্বংস কিংবা নিলামে বিক্রি করছে। কিন্তু প্রতিনিয়ত যে পরিমাণ পণ্য ও কনটেইনার বন্দরে জমে যাচ্ছে তার বিপরীতে নিলাম বা ধ্বংসের হার নগণ্য। যা বন্দরের জন্য হুমকিজনক। যদিও বিপজ্জনক পণ্য নিয়ে আন্তর্জাতিক নৌ-সংস্থা প্রণীত ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম ডেঞ্জারাস গুডস বা আইএমডিজি কোড আছে। তাতে ৯টি ক্যাটাগরির পণ্যের একটি তালিকা রয়েছে। তার মধ্যে আছে বিস্ফোরক, বিপজ্জনক গ্যাস, দাহ্য তরল ও কঠিন পদার্থ, বিষাক্ত ও তেজস্ক্রিয় পদার্থ।
সূত্র আরো জানায়, চট্টগ্রাম বন্দরের অভ্যন্তরের পি শেডে এখন পর্যন্ত ৭ লট পণ্য ও বিভিন্ন ইয়ার্ডে ৩৬৮ টিইইউএস (টোয়েন্টি ফিট ইকুইভ্যালেন্ট ইউনিটস) বিপজ্জনক পণ্যবাহী কনটেইনার রয়েছে। পাশাপশি ৩৮৪ টিইইউএস পচনশীল পণ্য ও ৪ হাজার ৩০০ টিইইউএস সাধারণ পণ্যবাহী কনটেইনার নিলাম বা ধ্বংসের অপেক্ষায় রয়েছে। বন্দরের অভ্যন্তর থেকে দীর্ঘদিনের পুরনো ওসব পণ্য নিলাম কিংবা ধ্বংসের ওপর জোর দেয়া হলেও বিভিন্ন জটিলতায় শুল্ক বিভাগ কর্তৃক সব ধরনের বিপজ্জনক পণ্য ও পণ্যবাহী কনটেইনার ধ্বংস করা হয়নি।
এদিকে চট্টগ্রাম বন্দরে বিপজ্জনক পণ্য নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ইতিমধ্যে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে। বন্দরের পক্ষ থেকে দেয়া চিঠিতে বলা হয়, বিপুল পরিমাণ বিপজ্জনক পণ্যসহ চট্টগ্রাম বন্দরের অভ্যন্তরের পণ্য পড়ে থাকার ফলে দুর্ঘটনা এবং পরিবেশ ও মানবদেহের ক্ষতির আশঙ্কা তৈরি করেছে। তাছাড়া তাতে বন্দরের পণ্য সংরক্ষণে স্থান সংকট তৈরি করে কাক্সিক্ষত উৎপাদনশীলতাকে বাধাগ্রস্ত করছে। সম্প্রতি মন্ত্রিপরিষদ সচিবের সভাপতিত্বে এ-সংক্রান্ত একটি বৈঠকে গত ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে ধ্বংস ও নিলাম কার্যক্রম সম্পন্ন হওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। কিন্তু বিভিন্ন জটিলতায় এখনো তা পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি। বাংলাদেশ ন্যাশনাল অথরিটি ফর কেমিক্যাল ওয়েপনস কনভেনশন (বিএনএসিডব্লিউসি) জাতীয় স্বাথের কথা বিবেচনা করে বিপজ্জনক সব রাসায়নিক দ্রব্য নিয়ে কাজ করছে। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক সভায় সংস্থাটির চেয়ারম্যান জানান, রাসায়নিক দ্রব্য বিরূপ পরিবেশে বিস্ফোরিত হতে পারে এবং বিপর্যয় ঘটাতে পারে। ওই নির্দেশনা অনুযায়ী বিএনএসিডব্লিউসি থেকে বিভিন্ন বিভাগের বিশেষজ্ঞ প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত কমিটি চট্টগ্রাম বন্দরসহ মোংলা ও বেনাপোল পরিদর্শন করেছে। পরিদর্শনের পর রাসায়নিক দ্রব্য মজুদজনিত ঝুঁকি চিহ্নিত করে যে রিপোর্ট দেয়া হয়েছে তাতে বলা হয়েছে, বন্দর দিয়ে আমদানি হওয়া কেমিক্যাল পণ্যের গায়ে কোনো লেবেল না থাকায় ঝুঁকিপূর্ণ রাসায়নিক দ্রব্য বন্দরে চিহ্নিত করা যায় না। ফলে মজুদের ক্ষেত্রে আলাদাভাবে সতর্কতা অবলম্বন করা সম্ভব হয় না।
অন্যদিকে শুল্ক বিভাগ সংশ্লিষ্টরা জানায়, কাস্টমস আইনে অকশন করার প্রক্রিয়া বলা আছে। পণ্য আমদানির পর ৩০ দিন পার হলে কাস্টমস প্রক্রিয়া অনুসরণ করে পণ্য নিলামে তোলা হয়। তবে দাহ্য পদার্থ বা বিপজ্জনক পণ্যের জন্য আলাদা করে নিলাম হয় না। নিয়মানুযায়ী সর্বোচ্চ দর পেলে তা বিক্রির অনুমোদন দেয়া হয়। কিন্তু প্রক্রিয়া মতে ৩ বার অকশন করতে মাসের পর মাস লেগে যায়। আবার অকশন করতে গেলে স্বার্থান্বেষী মহল প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বাধা দেয়।
এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম কাস্টমস কমিশনার মো. ফখরুল আলম জানান, আমদানিকারক যদি পণ্য এনেও সময়মতো খালাসের পদক্ষেপ না নেয় তখন শুল্ক বিভাগ নিলামের পদক্ষেপ নিতে পারে। পরবর্তী সময়ে অকশন প্রক্রিয়ায়ও যদি তার সুরাহা না হয় তখন ধ্বংসের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তবে দ্রুত পদক্ষেপ নিয়ে সীমাবদ্ধতাগুলো কাটিয়ে নিয়মিতভাবে ধ্বংস করা হলে এভাবে বিপজ্জনক পণ্যের স্তূপ জমবে না।
একই প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম শাহজাহান জানান, চট্টগ্রাম বন্দরের অভ্যন্তরে থাকা বিপজ্জনক পণ্য সরানোর ব্যাপারে দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে যে বড় বিপদের কারণ হতে পারে তা বন্দর কর্তৃপক্ষ অবহিত করে আসছে। কাস্টমস কর্তৃপক্ষ ইতিমধ্যে বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। তবে যে পরিমাণ পণ্য জমে আছে সে অনুযায়ী কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে না। নিরাপত্তা বিবেচনায় এখানে আরো দ্রুতত কাজ করা জরুরি।
আরও পড়ুন
যেসব জেলায় ঝোড়ো হাওয়াসহ বজ্রবৃষ্টি হতে পারে আজ
জিপি,রবি,বাংলালিংক ছাড়া ইন্টারনেটের দাম কমালো সবাই
পৃথক মামলায় আমু-আনিসুলসহ ৭ জনকে গ্রেফতার দেখানো হলো