April 19, 2025

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Tuesday, April 8th, 2025, 2:06 pm

হজরত ইবরাহিমের (আ.) ফিলিস্তিনে হিজরত

মসজিদুল আকসা, ফিলিস্তিন

অনলাইন ডেস্ক

ইবরাহিম (আ.) আল্লাহর নবি এবং তার অত্যন্ত নেক ও প্রিয় একজন বান্দা। তার ইমানের দৃঢ়তা, আল্লাহমুখিতা, একনিষ্ঠতা ছিল অতুলনীয়। তাকে আবুল আম্বিয়া বা নবিদের পিতা বলা হয়। আল্লাহ তাআলা তার বংশের বহু সংখ্যাক ব্যক্তিকে নবুয়্যত দিয়ে সম্মানিত করেছেন। আল্লাহর শেষ নবি হজরত মুহাম্মাদও (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়সাল্লাম) তার বংশধর।

কোরআনে আল্লাহ তাআলা নবি ইবরাহিমের (আ.) আনুগত্য ও একনিষ্ঠতার প্রশংসা করেছেন এবং নবিজিকে নির্দেশ দিয়েছেন তার মিল্লাত বা মতাদর্শ অনুসরণ করতে। আল্লাহ বলেন, নিশ্চয় ইবরাহিম ছিলেন এক উম্মত, আল্লাহর একান্ত অনুগত ও একনিষ্ঠ। তিনি মুশরিকদের অন্তর্ভূক্ত ছিলেন না। তিনি ছিলেন আল্লাহর অনুগ্রহের জন্য কৃতজ্ঞ; আল্লাহ তাকে মনোনীত করেছিলেন এবং তাকে পরিচালিত করেছিলেন সঠিক পথে। আমি তাকে দুনিয়াতে কল্যাণ দান করেছিলাম, আর আখেরাতেও তিনি অবশ্যই সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত। তোমার প্রতি ওহি করছি যে, তুমি একনিষ্ঠ ইবরাহিমের মতাদর্শ অনুসরণ কর। (সুরা নাহল: ২০-২৪)

কোরআনের বহু আয়াতে তার নাম এসেছে। কোরআনে একটি সুরাও রয়েছে তার নামে। কাবা নির্মাণ, ছেলেকে কোরবানি করতে নিয়ে যাওয়া, নমরুদের সাথে বিতর্ক, তার জন্য আগুন আরামদায়ক হয়ে যাওয়া ইত্যাদি তার জীবনের বহু ঘটনা কোরআনে বর্ণিত হয়েছে।

হজরত ইবরাহিমের জন্মভূমি ছিল ইরাক। ইরাকেই তিনি নবুয়্যত লাভ করেন এবং নিজের জাতির মানুষকে আল্লাহর দীনের দাওয়াত দেন। তাদেরকে মূর্তিপূজার অসারতা বোঝানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু দীর্ঘ দিন অনেক চেষ্টার পরও তারা আল্লাহর দীনের প্রতি বিমুখই থেকে যায়। এক পর্যায়ে তারা তাকে আগুনে পুড়িয়ে শাস্তি দেওয়ার চেষ্টা করে। শেষ পর্যন্ত তিনি সিদ্ধান্ত নেন, নিজের শহর ত্যাগ করে অন্য কোনো জায়গায় হিজরত করবেন, যেন সেখানে আল্লাহর দীন প্রচার করতে পারেন এবং অন্য কোনো জাতিকে আল্লাহর ইবাদতের দিকে ডাকতে পারেন।

আমরা লক্ষ্য করি, হজরত ইবরাহিমের (আ.) হৃদয়ের কোমলতা, তার দয়া ও করুণা এতটা বেশি ছিল যে, তিনি নিজের জাতিকে কোনো অভিশাপ দেননি, তাদের ধ্বংসের জন্য দোয়া করেননি। বরং তিনি চুপচাপ অন্য জায়গায় চলে গিয়েছিলেন। যদিও ইসরাইলি কিছু বর্ণনায় এসেছে যে, আল্লাহ তাআলা তাদেরকে মশা পাঠিয়ে শাস্তি দিয়েছিলেন বা অন্য কোনোভাবে ধ্বংস করেছিলেন, তবে এ বিষয়ে কোরআন বা সহিহ হাদিসে কোনো স্পষ্ট প্রমাণ নেই। যদি আল্লাহ তাদের শাস্তি দিতেন, তবে নিশ্চয়ই তা কোরআনে উল্লেখ থাকত, যেমন অন্য জাতির শাস্তির বর্ণনা এসেছে।

প্রখ্যাত মুফাসসির আব্দুর রহমান ইবনে নাসের আস-সা’দী (রহ.) বলেন, কোরআনে ইবরাহিমের (আ.) জাতির শাস্তির বর্ণনা না থাকার কারণ সম্ভবত এই যে, ইবরাহিম (আ.) ছিলেন অত্যন্ত দয়ালু, মহৎ এবং ধৈর্যশীল ব্যক্তি। তিনি অন্য অনেক নবির মতো নিজের জাতির ওপর অভিশাপ দেননি। আল্লাহ তাআলাও তার কারণে তাদের উপর কোনো ব্যাপক শাস্তি নাজিল করেননি। এর প্রমাণ হলো, তিনি এমনকি নবি লুতের (আ.) জাতিকে ধ্বংসের ব্যাপারে ফেরেশতাদের সঙ্গে বিতর্ক করেছিলেন, তাদের পক্ষে কথা বলেছিলেন—যদিও তারা তাঁর নিজের জাতিও ছিল না।

হজরত ইবরাহিম (আ.) নিজের স্ত্রী সারা ও ভাতিজা লুতকে (যিনি পরবর্তীতে নবি হন) নিয়ে জন্মভূমি ইরাক থেকে হিজরত করে শামের বরকতময় ভূমিতে চলে যান। সেখানে আল্লাহ তাআলা তাকে সন্তান দান করেন। তার পরিবারকে বিশেষভাবে সম্মানিত করেন।

কোরআনে সুরা আনকাবুতে আল্লাহ তাআলা বলেন, ইবরাহিমের কওমের জবাব ছিল কেবল এই যে, তারা বলল, ওকে হত্যা কর অথবা জ্বালিয়ে দাও। তারপর আল্লাহ আগুন থেকে তাকে রক্ষা করলেন; নিশ্চয়ই এতে নিদর্শন রয়েছে মুমিনদের জন্য। ইবরাহিম বলল, তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে মূর্তিগুলিকে উপাস্যরূপে গ্রহণ করেছ পার্থিব জীবনে তোমাদের পারস্পরিক বন্ধুত্বের খাতিরে; কিন্তু কিয়ামতের দিন তোমরা একে অপরকে অস্বীকার করবে এবং পরস্পরকে অভিসম্পাত দেবে। তোমাদের আবাস হবে জাহান্নাম এবং তোমাদের কোন সাহায্যকারী থাকবে না। লুত তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করল। ইবরাহিম বলল, আমি আমার রবের উদ্দেশ্যে দেশ ত্যাগ করছি। তিনি তো পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়। আর আমি তাকে দান করলাম ইসহাক ও ইয়াকুবকে এবং তার বংশে নবুওয়াত ও কিতাব দিলাম। আর দুনিয়াতে তাকে তার প্রতিদান দিলাম এবং নিশ্চয় সে আখিরাতে সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত হবে। (সুরা আনকাবুত: ২৪-২৬)

সুরা আম্বিয়ায় আল্লাহ তাআলা বলেন, ইবরাহিম বললেন, তোমরা কি আল্লাহর পরিবর্তে এমন কিছুর এবাদত কর, যা তোমাদের কোন উপকার ও করতে পারে না এবং ক্ষতিও করতে পারে না? ধিক তোমাদের জন্যে এবং তোমরা আল্লাহ ব্যতীত যাদেরই এবাদত কর, ওদের জন্যে। তোমরা কি বোঝ না? তারা বলল, একে পুড়িয়ে দাও এবং তোমাদের উপাস্যদের সাহায্য কর, যদি তোমরা কিছু করতে চাও।

আমি বললাম, হে অগ্নি, তুমি ইবরাহিমের উপর শীতল ও নিরাপদ হয়ে যাও। তারা ইবরাহিমের বিরুদ্ধে ফন্দি আঁটতে চাইল, আমি তাদেরকেই সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্থ করে দিলাম। আমি তাকে ও লুতকে উদ্ধার করে সেই দেশে পৌঁছিয়ে দিলাম, যেখানে আমি বিশ্বের জন্যে বরকত রেখেছি। আমি তাকে দান করলাম ইসহাক ও পুরস্কার স্বরূপ দিলাম ইয়াকুব এবং প্রত্যেককেই সৎকর্ম পরায়ণ করলাম। আমি তাদেরকে নেতা করলাম। তারা আমার নির্দেশ অনুসারে পথ প্রদর্শন করতেন। আমি তাদের প্রতি ওহি নাজিল করলাম সৎকর্ম করার, নামাজ কায়েম করার এবং জাকাত দান করার। তারা আমার এবাদতে ব্যাপৃত ছিল। (সুরা আম্বিয়া: ৬৬-৭৩)

এ আয়াতগুলো থেকে বোঝা যায় হজরত ইবরাহিম (আ.) ইরাক থেকে শামের (বর্তমান সিরিয়া-ফিলিস্তিন অঞ্চল) বরকতময় ভূমি অর্থাৎ মসজিদুল আকসা সংলগ্ন অঞ্চলে হিজরত করেছিলেন। কোরআনের অন্যান্য আয়াতে এ অঞ্চলটিকেই পবিত্র বা বরকতময় ভূমি বলা হয়েছে। যেমন নবিজিকে (সা.) এক রাতের ভ্রমণে আল আকসায় নিয়ে যাওয়া প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন, পবিত্র মহান সে সত্তা, যিনি তাঁর বান্দাকে রাতে নিয়ে গিয়েছেন মাসজিদুল হারাম থেকে মাসজিদুল আকসা পর্যন্ত, যার আশপাশে আমি বরকত দিয়েছি, যেন আমি তাকে আমার কিছু নিদর্শন দেখাতে পারি। নিশ্চয় তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা। (সুরা ইসরা: ১)

ফিলিস্তিনের মসজিদ আল আকসা সংলগ্ন অঞ্চলে ইবরাহিম (আ.) দশ বছর অবস্থান করেন। এরপর তিনি হজরত হাজেরাকে (আ.) বিয়ে করেন এবং তাকে নিয়ে মক্কায় চলে যান। পরে আবার ফিলিস্তিনে ফিরে যান এবং সেখানেই বসবাস করতে থাকেন। তিনি মাঝে মাঝে ফিলিস্তিন থেকে মক্কায় যেতেন। মক্কায় নিজের ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে তিনি পবিত্র কাবা নির্মাণ করেন যেমন কোরআনে বর্ণিত হয়েছে। এ ছাড়াও মাঝেমধ্যে তিনি ইসমাইলের (আ.) সঙ্গে দেখা করতে মক্কায় যেতেন, যেমন বিভিন্ন হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু তার স্থায়ী আবাসভূমি ছিল ফিলিস্তিনের মসজিদুল আকসা সংলগ্ন অঞ্চল।