আব্দুর রহমান মিন্টু, রংপুর : বাগানের গাছে গাছে ঝুলছে হাড়িভাঙ্গা আম স্বাদে-গন্ধে অতুলনীয় ও জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃত উত্তরাঞ্চলের বিখ্যাত হাড়িভাঙ্গা আম বাজারে মিলবে জুনের তৃতীয় সপ্তাহে। চলতি বছরে রংপুরে প্রায় ২ হাজার হেক্টর জমিতে হাড়িভাঙ্গা আমের চাষ করা হয়েছে। সবকিছু ঠিক থাকলে এ বছরেও ২০০ কোটির বেশি টাকার হাড়িভাঙ্গা আম বিক্রি করা সম্ভব হবে বলে আশাপবাদী চাষি ও ব্যবসায়ীরা।
রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার তেকানি বাজার এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে, শেষ সময়ে ঝড়-বৃষ্টির হাত থেকে আম রক্ষা করতে পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় পার করছেন চাষিরা। এ মৌসুমে দুই দফায় ঝড় হওয়ায় ফলন কিছুটা কম হবে বলে আশঙ্কা করছেন তারা। একই সঙ্গে আবহাওয়া অধিদপ্তরের সাম্প্রতিক ঝড়ের পূর্বাভাস নতুন করে উদ্বেগ বাড়িযেছে আমচাষিদের মধ্যে।
তেকানির আমচাষি বেলাল হোসেন বলেছেন, “এবার মুকুল আসার পর থেকে তিন বার ঝড় হয়েছে। এর ফলে আমের ফলন গতবারের তুলনায় কম হয়েয়ে। আম পাড়ার আর এক মাস সময় বাকি। যদি ফের বড় ধরনের ঝড় হয়, তবে আমরা বড় ক্ষতির মুখে পড়ব।”
চাষিরা বলছেন, হাড়িভাঙ্গা আম পাকলে এটি তিন-চার দিনের বেশি রাখা যায় না। সংরক্ষণের কোনো কার্যকর পদ্ধতি নেই। যদি এই আম সংরক্ষণের সঠিক প্রক্রিয়া থাকত, তাহলে স্থানীয়চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি করা সম্ভব হতো।
হাড়িভাঙ্গা আমের গোড়াপত্তনকারী নফল উদ্দিন পাইকারের ছেলে আমজাদ হোসেন পাইকার বলেছেন, “দীর্ঘদিন ধরে শুনে আসছি, কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট এই আমের লাইফলাইন নিয়ে কাজ করছে। কিন্তু, আমরা এখনো এর কোনো সুফল দেখিনি। সম্প্রতি হাড়িভাঙ্গা আম জিআই পণ্যের স্বীকৃতি পেলেও স্থানীয়ভাবে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। অনেক চাষি ও ব্যবসায়ী এই স্বীকৃতির গুরুত্ব সম্পর্কেও অবগত নন। হাড়িভাঙ্গার মূল উৎপাদন এলাকা পদাগঞ্জে রাস্তার বেহাল অবস্থা, আবাসিক সুবিধার অভাব, ব্যাংকিং সেবা অনুপস্থিত এবং আম বাজারজাতের জন্য নেই স্থায়ী শেড। এসব সমস্যার দ্রুত সমাধান হওয়া দরকার।”
রংপুর কৃষি বিভাগ ও আমচাষিরা জানিয়েছেন, জুনের তৃতীয় সপ্তাহে বাজারে মিলবে পরিপক্ব ও রপ্তানিযোগ্য হাড়িভাঙ্গা আম। এর আগে বাজারে হাড়িভাঙ্গা দেখা গেলেও তা অপরিপক্ব হবে। প্রকৃত স্বাদ পেতে হলে জুনের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত অপেক্ষা করাই ভালো। বর্তমানে বাগানগুলোতে চলছে শেষ ধাপের পরিচর্যা।
রংপুর অঞ্চলে হাড়িভাঙ্গা আমের ফলন সবচেয়ে বেশি হলেও ফজলি, সাদা ল্যাংড়া, কালা ল্যাংড়া, মিশ্রিভোগ, গোপালভোগ, আম্রপালিসহ আরো অনেক জাতের আম চাষ হয়। এসব আমের মধ্যে হাড়িভাঙ্গার চাহিদা সবচেয়ে বেশি।
চলতি বছর হাড়িভাঙ্গা আম জিআই পণ্যের স্বীকৃতি পেয়েছে, যা এ অঞ্চলের চাষিদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অর্জন। তবে, জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেলেও হাড়িভাঙ্গা আম সংরক্ষণের কার্যকর কোনো পদ্ধতি এখনো উদ্ভাবন হয়নি। ফলে, এই আম সংরক্ষণের ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে। চাষি ও ব্যবসায়ীদের দাবি, হাঁড়িভাঙ্গা পরিবহনের জন্য বিশেষ বাস ও ট্রেন সার্ভিস চালু করা দরকার। সেই সঙ্গে ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করতেও প্রশাসনকে সক্রিয় হতে হবে। হাঁড়িভাঙ্গার রাজধানী হিসেবে পরিচিত পদাগঞ্জ হাটের রাস্তা সংস্কার, বাজারে শেড নির্মাণ, ব্যাংকিং সুবিধা, পাবলিক টয়লেট এবং বৃষ্টির সময় পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করার দাবি জানিয়েছেন তারা।
রংপুর কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, হাড়িভাঙ্গা আম সংরক্ষণের ওপর কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট কাজ করছে। তবে, কবে নাগাদ গবেষণার ফল আসবে, তা নিশ্চিত করে বলতে পারেনি সংশ্লিষ্ট দপ্তর। হাড়িভাঙ্গার লাইফলাইন ও সংরক্ষণ পদ্ধতি নিয়ে স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে গবেষণা চলছে।
হাড়িভাঙ্গা আমের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে—এটি আঁশহীন, সুস্বাদু, আঁটি ছোট ও ছাল পাতলা। প্রতিটি আমের ওজন হয় ২০০ থেকে ৩০০ গ্রাম। মৌসুমের শুরুতে এর চাহিদা বেশি থাকায় প্রতি কেজি হাড়িভাঙ্গা ৬০ থেকে ১০০ টাকা দরে বিক্রি হয়। তবে, এবার ফলন কিছুটা কম হওয়ায় দাম কিছুটা বেশি হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এই সুমিষ্ট আমের চাষ প্রতিবছরই বাড়ছে। রংপুর সদর, মিঠাপুকুর ও বদরগঞ্জ উপজেলার বিস্তৃত ফসলি জমি ও উঁচু-নিচু পরিত্যক্ত জমিতেও এ আম চাষ হচ্ছে।
রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো: সিরাজুল ইসলাম জানিয়েছেন, চলতি বছর রংপুর জেলায় ৩ হাজার ৩৫৯ হেক্টর জমিতে আম চাষ করা হচ্ছে। এর মধ্যে ১ হাজার ৯১০ হেক্টরে চাষ করা হচ্ছে হাড়িভাঙ্গা। আম উৎপাদনের লক্ষ্য ধরা হয়েছে ২৯ হাজার ৭১০ মেট্রিক টন। জুনের তৃতীয় সপ্তাহে রপ্তানিযোগ্য হাড়িভাঙ্গা আম পাড়া শুরু হবে। তবে, সুনির্দিষ্ট তারিখ এখনো নির্ধারণ করা হয়নি। মে মাসের শেষ সপ্তাহে পদাগঞ্জ হাটে জেলা প্রশাসন, কৃষি বিভাগ ও চাষিদের সমন্বয়ে আনুষ্ঠানিক বৈঠকে সে তারিখ নির্ধারণ করা হবে।
রংপুর জেলা প্রশাসক রবিউল ফয়সাল বলেছেন, ‘জিআই পণ্যের স্বীকৃতি পাওয়া হাড়িভাঙ্গা আম বাজারজাত করতে এবার যাতে কোনো অসুবিধা না হয়, সে বিষয়ে মনিটর করা হবে। পরিবহনকালে ব্যবসায়ীরা যাতে হয়রানির শিকার না হন, সেজন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সমন্বয়ে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে। পাশাপাশি সরকারি পরিবহন সুবিধাও বিবেচনা করা হবে। নির্ধারিত সময়ের আগে হাড়িভাঙ্গা আম বাজারজাত না করতে চাষিদের পরামর্শ দিয়েছেন জেলা প্রশাসক।
আরও পড়ুন
মোংলা বন্দরে জাহাজ থেকে চুরি করা মালামালসহ তিনজন আটক
এই অ্যাওয়ার্ড শুধু স্বীকৃতি নয়, সকলের জন্য অনুপ্রেরণা : উপাচার্য
কালীগঞ্জে বাণিজ্যিক ভাবে চাষ হচ্ছে ড্রাগন ফল