আল জাজিরা ও রয়টার্স:
ইয়েমেনের ইরান-সমর্থিত হুতি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে বড় আকারে সামরিক হামলা চালাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। এ হামলায় ইয়েমেনে এখন পর্যন্ত কমপক্ষে ৩১ জন নিহত হয়েছেন।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্দেশে গতকাল শনিবার এ হামলা শুরু হয়। স্থানীয় সময় আজ রোববার ভোরেও হামলা অব্যাহত ছিল।
ট্রাম্প গত ২০ জানুয়ারি দ্বিতীয় দফায় মার্কিন প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেন। তাঁর হোয়াইট হাউসে ফেরার পর এই প্রথম মধ্যপ্রাচ্যে বড় পরিসরে সামরিক হামলা চালাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র।
যুক্তরাষ্ট্রের এক কর্মকর্তা বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেছেন, হুতিদের বিরুদ্ধে মার্কিন সামরিক অভিযান কয়েক সপ্তাহ ধরে চলতে পারে।
হুতি কারা, আর কেনইবা এই বিদ্রোহী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র এখন বড় পরিসরে হামলা চালাচ্ছে, আল–জাজিরা ও বার্তা সংস্থা রয়টার্সের তথ্যের আলোকে তা পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো—
হুতি বিদ্রোহী কারা
হুতি বিদ্রোহীরা ইয়েমেনের একটি সশস্ত্র গোষ্ঠী। তারা ইয়েমেনের রাজধানী সানাসহ দেশটির বেশির ভাগ অংশ নিয়ন্ত্রণ করছে।
গোষ্ঠীটির আবির্ভাব ঘটে গত শতকের নব্বইয়ের দশকে। তবে তারা প্রথমবারের মতো দেশ-বিদেশে ব্যাপক আলোচনায় আসে ২০১৪ সালে। সে সময় তারা ইয়েমেনের রাজধানী সানা দখল করে। দেশটির তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আবদরাব্বু মনসুর হাদিকে তারা ইয়েমেন ছেড়ে পালাতে বাধ্য করে।
২০১৫ সালের মার্চে সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ইয়েমেনে হস্তক্ষেপ করে। এই অভিযানে সৌদিকে সমর্থন দেয় পশ্চিমারা। সামরিক জোট ইয়েমেনে হুতিদের বিরুদ্ধে ব্যাপক বিমান ও স্থল হামলা শুরু করে। তবে তারা শেষ পর্যন্ত ইরান-সমর্থিত হুতিদের পরাজিত করতে ব্যর্থ হয়।
জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় ২০২২ সালের এপ্রিলে ইয়েমেনে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়। ইয়েমেন ও সৌদি আরব এখন শান্তি আলোচনায় রয়েছে।
জাহাজে হুতিদের হামলা
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে নজিরবিহীন হামলা চালায় গাজাভিত্তিক ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র সংগঠন হামাস। এ হামলায় প্রায় ১ হাজার ২০০ মানুষ নিহত হন। ২৫১ জনকে জিম্মি করে গাজায় নিয়ে যাওয়া হয়।
জবাবে সেদিন থেকেই গাজায় নির্বিচার হামলা শুরু করে ইসরায়েল। গাজা যুদ্ধে ইসরায়েলকে সমর্থন দেয় যুক্তরাষ্ট্র।
গাজায় ইসরায়েলি হামলার প্রতিবাদে এবং ফিলিস্তিনি ও হামাসের প্রতি সমর্থন জানিয়ে ২০২৩ সালের নভেম্বরে লোহিত সাগরে চলাচলকারী ইসরায়েল সংশ্লিষ্ট জাহাজ নিশানা করে হামলা শুরু করে হুতিরা।
গত ১৯ জানুয়ারি গাজায় প্রথম ধাপের যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়। যুদ্ধবিরতির পর হুতিরা জাহাজ নিশানা করে ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা বন্ধ করে দেয়।
গাজায় যুদ্ধবিরতির মেয়াদ শেষ হয় ১ মার্চ। হামাস পরিচালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুসারে, গাজায় ১৫ মাসের যুদ্ধে ইসরায়েলি হামলায় ৪৮ হাজার ৫০০ জনের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। আহত লাখো ফিলিস্তিনি। গাজার বাসিন্দাদের বেশির ভাগই বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। গাজার প্রায় ৭০ শতাংশ ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়ে গেছে। প্রথম ধাপের যুদ্ধবিরতিকালে ইসরায়েলে-ফিলিস্তিনি পক্ষের মধ্যে জিম্মি ও বন্দী বিনিময় হয়।
হুতিদের বিরুদ্ধে বড় হামলার নির্দেশ
গাজায় থাকা বাকি ইসরায়েলি জিম্মিদের মুক্তি দিতে হামাসকে বাধ্য করতে সম্প্রতি উপত্যকায় সব ধরনের ত্রাণ সরবরাহ বন্ধ করে দেয় ইসরায়েল। ত্রাণের পর তারা গাজায় বিদ্যুৎ সরবরাহও বন্ধ করে। অন্তত তিন সপ্তাহ ধরে গাজায় এই অবরোধ চলছে।
এমন প্রেক্ষাপটে লোহিত সাগরে ইসরায়েল-সংশ্লিষ্ট জাহাজগুলোতে আবার হামলার হুমকি দেয় হুতিরা। এই হুমকির পর এখন হুতিদের বিরুদ্ধে বড় পরিসরে সামরিক অভিযান শুরু করল যুক্তরাষ্ট্র।
হুতি পরিচালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আজ রোববারের হালনাগাদ তথ্য অনুসারে, মার্কিন হামলায় অন্তত ৩১ জন নিহত হয়েছেন। আর আহত হয়েছেন ১০১ জন। হতাহত ব্যক্তিদের বেশির ভাগই নারী ও শিশু।
হুতিদের বিরুদ্ধে হামলার বিষয়ে ট্রাম্প তাঁর ট্রুথ সোশ্যাল নামের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া পোস্টে বলেন, ‘তোমার সময় শেষ। আর আজ থেকেই তোমাদের হামলা বন্ধ করতে হবে। যদি তা না হয়, তাহলে নরক তোমাদের ওপর এমন বৃষ্টি বর্ষণ করবে, যা তোমরা আগে কখনো দেখোনি।’
ট্রাম্পে আরও বলেন, তিনি মার্কিন সেনাবাহিনীকে ইয়েমেনে হুতিদের বিরুদ্ধে একটি নিষ্পত্তিমূলক ও শক্তিশালী সামরিক অভিযান শুরুর নির্দেশ দিয়েছেন।
ওয়াশিংটন তার লক্ষ্য অর্জন না হওয়া পর্যন্ত ইয়েমেনে হুতিদের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রাণঘাতী শক্তি প্রয়োগ করবে বলে উল্লেখ করেন ট্রাম্প।
ট্রাম্প তাঁর পোস্টে হুতিদের বড় সমর্থক ইরানকেও হুমকি দেন। হুতিদের যাতে সমর্থন দেওয়া তেহরান অবিলম্বে বন্ধ করে, সে কথাও বলেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। ট্রাম্প বলেছেন, যদি ইরান যুক্তরাষ্ট্রকে হুমকি দেয়, তাহলে তেহরানকে সম্পূর্ণরূপে জবাবদিহির আওতায় আনবে ওয়াশিংটন। তারা এ ব্যাপারে চুপ হয়ে থাকবে না।
হামলার মিথ্যা দাবি
গাজায় খাদ্য, জ্বালানিসহ অন্যান্য উপকরণ সরবরাহের ওপর ইসরায়েলি অবরোধের প্রতিবাদে গত সপ্তাহে জাহাজে হামলার হুমকি দেয় হুতিরা। কিন্তু হুমকি দেওয়া সত্ত্বেও তারা এখনো কোনো জাহাজে হামলা চালায়নি। তবে ট্রাম্প হুতিদের ওপর হামলা শুরুর অজুহাত হিসেবে লোহিত সাগরে জাহাজ নিশানা করে বিদ্রোহী গোষ্ঠীটির হামলার কারণ উল্লেখ করেছেন।
ট্রাম্প তাঁর ট্রুথ সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মে লিখেছেন, ইরানের অর্থায়নে হুতিরা মার্কিন বিমানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে। তারা যুক্তরাষ্ট্রের সেনা ও মিত্রদের লক্ষ্যবস্তু করেছে। হুতিদের জলদস্যুতা, সহিংসতা ও সন্ত্রাসবাদের জন্য ক্ষয়ক্ষতিসহ তা মোকাবিলায় বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছে। তারা জীবনকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে।
বদলা নেওয়ার হুমকি
যুক্তরাষ্ট্রের এই হামলাকে ‘যুদ্ধাপরাধ’ হিসেবে অভিহিত করেছে হুতিদের রাজনৈতিক ব্যুরো। তারা এক বিবৃতিতে বলেছে, মার্কিন আগ্রাসনের জবাব দেওয়া হবে। হুতিদের সশস্ত্র বাহিনী এই হামলার জবাব দিতে সম্পূর্ণ প্রস্তুত রয়েছে।
হুতিদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ইয়েমেনে মার্কিন হামলা গোষ্ঠীটিকে ফিলিস্তিনের প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখা থেকে বিরত রাখতে পারবে না।
সাবেক মার্কিন কূটনীতিক নাবিল খুরি আল-জাজিরাকে বলেছেন, হুতিদের বিরুদ্ধে হামলা চালানোর বিষয়ে ট্রাম্পের সিদ্ধান্তটি বিপথগামী। এই হামলা বিদ্রোহী গোষ্ঠীকে দমন করতে পারবে না। যা ঘটছে তার কোনো সামরিক যুক্তি নেই, কোনো রাজনৈতিক যুক্তিও নেই।
আরও পড়ুন
৬৫ দিন ধরে নিখোঁজ বিএনপি নেতা পান্নু, ফখরুলের উদ্বেগ
শিক্ষকদের বেতন ২০ মার্চের মধ্যে, বোনাস ২২ তারিখের পর
কিডনিতেও বাসা বাঁধছে ছত্রাক, কীভাবে সমাধান?