খুলনা ব্যুরো:
গত বছর ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিভিন্ন স্থানে সন্ত্রাসী বাহিনীর উত্থান হয়েছে। খুলনায় একের পর এক হত্যাকাণ্ড ঘটছে। তার প্রায় সবটাতে এসেছে হুমা বাহিনীর নাম।
খুলনা শহর থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে মহেশ্বরপাশা এলাকা। সাম্প্রতিক সময়ে সেখানে আধিপত্য বিস্তার ও মাদক সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণ নিতে একের পর এক রক্ত ঝরছে। সাড়ে তিন মাসে মহেশ্বরপাশা এলাকায় তিনটি হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। এ ছাড়া কুপিয়ে জখম এবং প্রকাশ্যে গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে বেশ কিছু। এসব ঘটনায় আসছে সন্ত্রাসী হুমায়ুন কবির হুমার নাম। তার তৎপরতায় এলাকার সাধারণ মানুষের মাঝে আতঙ্ক বিরাজ করছে।
পুলিশের কাছে সংরক্ষিত তথ্য অনুযায়ী, দৌলতপুর থানার মহেশ্বরপাশা বণিকপাড়ার বাসিন্দা মতলেব শেখের ছেলে হুমায়ুন কবির হুমা (৩৭)। তার বিরুদ্ধে একটি হত্যা, একটি অস্ত্র ও দুটি চাঁদাবাজি মামলা রয়েছে। গত বছরের ৯ অক্টোবর বাগেরহাটের রামপালে অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার হন তিনি। চলতি বছরের ২৪ জুলাই জামিনে মুক্তি পেয়ে হয়ে উঠেছেন বেপরোয়া।
স্থানীয়রা বলছেন, এ বছরের বিভিন্ন সময় পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন সন্ত্রাসী নাসিম, আরমান, হোসেন ঢালী, শাহরিয়ার পাপ্পুসহ কয়েকজন। প্রায় ১০ মাস জেল খাটার পর গত জুলাইয়ে জামিনে বের হন হুমা। অন্য সন্ত্রাসীরা জেলে থাকার সুযোগে এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিতে তিনি বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। প্রকাশ্যে অস্ত্রের মহড়া দিচ্ছে তার বাহিনীর লোকজন। সর্বশেষ ২৮ অক্টোবর দুটি বাড়িতে ১৫ রাউন্ড গুলি ছোড়ে সন্ত্রাসীরা। ওই ঘটনায়ও হুমা বাহিনীর সম্পৃক্ততা পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। পরে অভিযান চালিয়ে ওসমান ও সেলিম নামের দুজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তারা হুমার লোক।
একের পর এক হত্যাকাণ্ড ও অস্ত্রবাজির ঘটনায় আতঙ্কে এলাকাবাসী। মহেশ্বরপাশা এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিতে মাঝে মাঝে সন্ত্রাসীরা সশস্ত্র মহড়া দিচ্ছে। প্রকাশ্যে এসব ঘটলেও প্রতিবাদ করার সাহস পাচ্ছে না কেউ। গত ২৮ অক্টোবর একজনের বাড়িতে গুলি ছোড়া হয়। এ ঘটনায় হুমা বাহিনী জড়িত বলে সন্দেহ ভুক্তভোগীর। তিনি বলেন, ‘আমাদের সঙ্গে হুমার কোনো দ্বন্দ্ব নেই। তারপরও বাড়িতে ৯ রাউন্ড গুলি করেছে। ওরা বলতেছে, ওরা ছাড়া কেউ এলাকায় থাকতে পারবে না।’
একের পর সন্ত্রাসী তৎপরতায় উদ্বিগ্ন মহেশ্বরপাশার সাধারণ মানুষ ভয়ে গণমাধ্যমে বক্তব্য দিতেও সাহস পাচ্ছেন না। তারা বলছেন, ‘আমরা কিছু বললে যখন তখন এসে হামলা চালানো হতে পারে।’
গত ১১ জুলাই দুপুরে মহেশ্বরপাশা পশ্চিমপাড়ার বাড়ির সামনে গুলি করে ও পায়ের রগ কেটে হত্যা করা হয় সাবেক যুবদল নেতা মাহবুবুর রহমান মোল্লাকে। এ ঘটনায় হুমার সহযোগী কাজী রায়হান, আসিফ মোল্লাসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। মামলার তদন্তে সন্ত্রাসী আরমানের সঙ্গে মাহবুবের সখ্য, হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশনের একটি বাড়ি দখল ও মাদক বিক্রির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে হুমার সঙ্গে দ্বন্দ্বের প্রসঙ্গ উঠে আসে। মামলার প্রথম তদন্ত কর্মকর্তা মীর আতাহার আলী জানান, কাজী রায়হান, আসিফ ও হুমা একসঙ্গে বাগেরহাট কারাগারে ছিলেন।
এর আগে ২০১৪ সালের ২৪ জুন খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) পকেট গেটের সামনে সাবেক ইউপি সদস্য ও যুবলীগ নেতা আরিফ হোসেনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় হুমার অনুসারী আসিফ মোল্লা ও রায়হানকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এই মামলায় হুমাকেও গ্রেপ্তার দেখানো হয়।
খুলনা মহানগর পুলিশের (কেএমপি) এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, মাহাবুব হত্যার ঘটনায় গ্রেপ্তারের পর জিজ্ঞাসাবাদে আসিফ ও রায়হান জানান, আরিফ হোসেনকেও তারা গুলি করেছে। অবশ্য বিষয়টি তারা আদালতে বা তদন্তকালে স্বীকার করেননি।
এ ছাড়া ৩ আগস্ট মহেশ্বরপাশা উত্তর বণিকপাড়া এলাকায় কুপিয়ে হত্যা করা হয় ঘের ব্যবসায়ী আলামিন হাওলাদারকে। ১ অক্টোবর মহেশ্বরপাশায় নিজ ঘরে খুন হন তানভীর হাসান শুভ। এসব ঘটনায় দৌলতপুর থানায় অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তিদের আসামি করে পৃথক মামলা হয়েছে। জড়িত কেউ এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার হয়নি।
কেএমপির উপকমিশনার (উত্তর) তাজুর ইসলাম বলেন, মাহাবুব, আলামিন ও শুভ হত্যার তিনটি ঘটনার যোগসূত্র রয়েছে। তদন্ত শেষ হওয়ার আগে কিছু বলা যাচ্ছে না।

দৌলতপুর থানার ওসি রফিকুল ইসলাম জানান, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িতদের গ্রেপ্তার অভিযান চলছে। দুজন গ্রেপ্তার হয়েছেন। বাকিরাও দ্রুত গ্রেপ্তার হবেন।
স্থানীয় বাসিন্দা ও পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, খুলনা মহানগর পুলিশের দৌলতপুর, আড়ংঘাটা ও খানজাহান আলী থানার সীমান্তে মহেশ্বরপাশা এলাকা। এর পাশেই রূপসা সেতু বাইপাস সড়ক এবং ডুমুরিয়া উপজেলা। জালের মতো ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য সড়ক দিয়ে পালিয়ে যাওয়া সহজ। অপরাধ ঘটিয়ে এসব সড়ক দিয়ে দ্রুত এলাকা ত্যাগ করে সন্ত্রাসীরা।
তারা আরও জানান, নব্বইয়ের দশকে মহেশ্বরপাশা, আড়ংঘাটা ও দেয়ানা এলাকায় পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির উত্থান ঘটে। এরপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। ওই সময় গ্রেপ্তার হওয়া সন্ত্রাসীরা দীর্ঘদিন কারাগারে ছিল। কেউ কেউ পালিয়ে ছিল ভারতে। ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর তারা ধীরে ধীরে এলাকায় ফিরতে থাকে। কয়েকজন কারাগার থেকে জামিনে মুক্তি পায়। এলাকায় ফিরে চাঁদাবাজি, দখল, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে তারা।
সন্ত্রাসীদের সম্পর্কে খোঁজখবর রাখেন এলাকার প্রবীণ কয়েকজন জানান, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর এলাকায় ফেরেন পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির নেতা শেখ শাহীনুল হক ওরফে বড় শাহীন। তার ছত্রছায়ায় এলাকায় বেপরোয়া হয়ে ওঠে উঠতি সন্ত্রাসী হোসেন ঢালী, আরমান হোসেন ও হুমায়ুন কবির হুমা। একপর্যায়ে নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে বিভক্ত হয়ে পড়ে তারা। হুমা নিজেই আলাদা বাহিনী তৈরি করে। এর মধ্যে সন্ত্রাসীদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে ১৫ মার্চ খুন হন বড় শাহীন।
দৌলতপুর থানা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ইমাম হোসেন বলেন, চার মাসে তিনটি খুন হলো, অথচ মূল আসামিদের গ্রেপ্তার করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। পুলিশের ঢিলেঢালা তৎপরতার কারণে সন্ত্রাসীরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।
থানা জামায়াতে ইসলামের আমির মোশাররফ আনসারী বলেন, নির্দিষ্ট এলাকায় একের পর এক খুন-সন্ত্রাস, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যর্থতাই মূল দায়ী। পুলিশ কেন তাদের গ্রেপ্তার করতে পারছে না– আমরা এর জবাব চাই।
বৃহত্তর খুলনা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সভাপতি শেখ আশরাফ উজ জামান বলেন, সম্প্রতি অনেক সন্ত্রাসীর রিমান্ড আবেদন মঞ্জুর হয়নি, দ্রুত জামিন হচ্ছে– বিষয়টি উদ্বেগজনক।
কেএমপি কমিশনার জুলফিকার আলী হায়দার বলেন, হত্যাকাণ্ডে প্রশিক্ষিত ও পেশাদার লোক জড়িত। ঘটনা ঘটিয়ে তারা পালিয়ে যায়। তারপরও বিভিন্ন এলাকা থেকে কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বাকিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
তিনি আরও বলেন, আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ এবং অভিযুক্তদের গ্রেপ্তারে পুলিশ তৎপর রয়েছে। কিন্তু স্থানীয় মানুষের সহযোগিতা পাওয়া যাচ্ছে না। সবার সহযোগিতা ছাড়া পুলিশের পক্ষে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন।

                
আরও পড়ুন
আতিকুর রহমান ইতালি যুবদলের পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে সহ-সাংগঠনিক পদে মনোনিত
বিদ্যুতের ঘাটতি কমাতে কালীগঞ্জে নির্মিত হচ্ছে ইনডোর পাওয়ার গ্রিড
সারিয়াকান্দিতে যমুনায় তীব্র ভাঙ্গন,কৃষি জমি হারিয়ে দিশেহারা কৃষকেরা