অনলাইন ডেস্ক :
এলাম, দেখলাম, জয় করলাম। আবরার আহমেদের গল্পটা এখন এমনই। তার অভিষেক টেস্টে দল জিততে পারবে কি না, তা বলবে সময়। তবে তিনি ঠিকই জিতে গেছেন। তাক লাগিয়ে দিয়েছেন প্রথম টেস্টেই রেকর্ড গড়া বোলিংয়ে। অবশ্য বিশ্ব ক্রিকেটে তিনি এখন বিস্ময় হলেও পাকিস্তান ক্রিকেট তার কাছ থেকে প্রত্যাশা করছিল দারুণ কিছুই। যার নাম ‘হ্যারি পটার’, জাদুকরি কিছু তো তার করারই কথা! মুখায়ব শিশুসুলভ, চোখে চশমা। সব মিলিয়ে পাকিস্তানের ঘরোয়া ক্রিকেটে আবরারকে সবাই ডাকেন ‘হ্যারি পটার’ নামে। অভিষেক টেস্টে সেই নামের স্বার্থকতাও তিনি প্রমাণ করলেন। বাস্তবতা যদিও বইয়ের পাতা কিংবা রূপালি পর্দার চিত্রনাট্য নয়। ক্রিকেট মাঠে কারও হাতে জাদুর কাঠিও থাকে না। তবে প্রতিভা, কবজি আর আর আঙুলের কারুকাজে বল হাতে জাদুই দেখালেন ২৪ বছর বয়সী লেগ স্পিনার। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে চলতি মুলতান টেস্টের প্রথম ইনিংসে ৭ উইকেট নিয়েই ইতিহাস গড়েন আবরার। পাকিস্তানের প্রথম স্পিনার হিসেবে শিকার করেন অভিষেক ইনিংসে ৭ উইকেট। ইংলিশদের প্রথম ৭ উইকেটই নিয়ে একপর্যায়ে অবশ্য ১০ উইকেটে সবকটি নেওয়ার সম্ভাবনাও জাগান তিনি। শেষ পর্যন্ত তা হয়নি। তবে দ্বিতীয় ইনিংসে তিনটি নিয়ে ম্যাচে ১০ উইকেট পূর্ণ করেন শনিবার। আরও একটি উইকেট যোগ করেন রোববার ম্যাচের তৃতীয় দিনে। সব মিলিয়ে অভিষেক টেস্টে আবরারের প্রাপ্তি ২৩৪ রানে ১১ উইকেট। অভিষেকে পাকিস্তানের হয়ে ১১ উইকেটের কীর্তি আছে কেবল আর একজনের। ১৯৯৬ সালে নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে ১৩০ রানে ৭ উইকেট নেন সাবেক ফাস্ট বোলার মোহাম্মদ জাহিদ। পাকিস্তানের স্পিনারদের মধ্যে অভিষেক টেস্টে ৮ উইকেটের বেশি আগে ছিল না আর কারও। পাকিস্তান ক্রিকেট ছাড়িয়ে সীমানা বিশ্ব ক্রিকেটে ছড়িয়ে দিলে, টেস্ট ইতিহাসে আবরারের আগে অভিষেকে ১১ উইকেট নিতে পেরেছেন ¯্রফে আর ৭ স্পিনার। তার কাছে পাকিস্তান ক্রিকেটের প্রত্যাশা ছিল বড় কিছুরই। অভিষেকে ১১ উইকেট চাওয়াটা বাড়াবাড়ি অবশ্যই। তবে তিনি দারুণ কিছু করবেন, এই আশা ছিল অনেকের। ঘরোয়া ক্রিকেটে যে তিনি ঝড় তুলেছেন লেগ স্পিনের মায়ায় শিকারের পর শিকার ধরে। গত অক্টোবরে পাকিস্তানের ঘরোয়া বড় দৈর্ঘ্যরে টুর্নামেন্ট কায়েদ-ই-আজম ট্রফিতে সিন্ধের হয়ে আবরার উইকেট নিয়েছেন নামতা গুনে। সাউদার্ন পাঞ্জাবের বিপক্ষে ম্যাচে ১১ উইকেট, খাইবার পাখতুনখাওয়ার বিপক্ষে ৯টি, বালুচিস্তানের বিপক্ষে ৮টি। সব মিলিয়ে ওই এক মাসেই ৬ ম্যাচে বোলিং করে তার শিকার ৪৩ উইকেট! তার জন্ম করাচিতে। যদিও তার শেকড় পাহাড়ি সৌন্দর্যের লীলাভূমি অ্যাবোটাবাদের কারাকোরাম হাইওয়ের পাশে ছোট্ট এক গ্রাম শিনকিয়ারিতে। সেখান থেকে এসে তার পরিবার থিতু হয় করাচিতে। সেখানে গল্পটা তার পাকিস্তানের আর দশজন ক্রিকেটারের মতোই। করাচির অলিগলি আর পথে পথে টেপ টেনিস খেলে বেড় ওঠা। প্রতিভার ঝলক দেখিয়ে কোনো একটা একাডেমিতে ঠাঁই পেয়ে যাওয়া। পাকিস্তান ক্রিকেটের মূল ¯্রােতে উঠে আসেন তিনি করাচি ‘জোন ৩’- এর হয়ে খেলে। করাচির সাতটি ক্রিকেট জোনের মধ্যে দুর্বলতম এটি। এই দলকেই আবরার শিরোপা এনে দেন ২০১৬ সালে ৫৩ উইকেট নিয়ে। পরে সাবেক পাকিস্তানি অধিনায়ক রশিদ লতিফের একাডেমিতে তিনি শাণিত করেন নিজের বোলিং। শীর্ষ পর্যায়ে পা রাখেন তিনি ২০১৭ পিএসএলে করাচি কিংসের হয়ে একটি ম্যাচ দিয়ে। উইকেট না পেলেও সেদিন তিনি ৪ ওভারে রান দেন মাত্র ২২। প্রতিপক্ষ দলে খেলা ওয়েন মর্গ্যান সেদিন ৫৭ বলে ৮০ রানের ইনিংস খেললে ইংলিশ ব্যাটসম্যানকে শান্ত রাখেন আবরার। মর্গ্যানকে করা ১৬ বলের ৭টিতেই তিনি রান দেননি সেদিন। মাহেলা জয়াবর্ধনে, কুমার সাঙ্গাকারার মতো কিংবদন্তিদের ভূয়সি প্রশংসা আদায় করে নেন তিনি সেদিন। সেবার পিএসএলে দুটি ম্যাচ খেলেই তিনি ছটকে পড়েন চোট নিয়ে। শুধু পিএসএল থেকেই নয়, ভয়ঙ্কর স্ট্রেস ফ্র্যাকচার তাকে ক্রিকেটের মূল ¯্রােত থেকে দূরে রাখে দীর্ঘদিন। একরকম হারিয়েই যান তিনি। অনেক লড়াই করে আবার তিনি নিয়মিত ক্রিকেটে ফেরেন ২০২০ সালে। সিদ্ধ প্রদেশের দ্বিতীয় একাদশের হয়ে সাদা ও লাল বলে দারুণ পারফরম্যান্স দেখিয়ে জায়গা আদায় করে নেন মূল দলে। এরপর কায়েদে-ই-আজম ট্রফিতে নিজেকে মেলে ধরেন দারুণভাবে। এগিয়ে যান উন্নতির পথ ধরে। ২০২-২১ মৌসুমে ৫ ম্যাচে নেন ১৬ উইকেট, গত মৌসুমে ২ ম্যাচে ১৭ উইকেট আর এবার ৬ ম্যাচে ৪৩ উইকেট। সেই ধারাবাহিকতায় ডাক পেয়ে যান পাকিস্তানের টেস্ট দলে। একসময় পাকিস্তান ক্রিকেটে তার পরিচিতি ছিল রহস্য স্পিনার হিসেবে। ক্যারম বল, ফ্লিকার থেকে শুরু করে আঙুলের টোকায় নানা কিছু করতেন। তবে সময়ের সঙ্গে আস্তে আস্তে জোর দেন প্রথাগত লেগ স্পিনে। সাফল্যও ধরা দেয় সেই পথে। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজের প্রথম টেস্টেই তাকে খেলানো হবে বলে ধারণা করা হচ্ছিল। কিন্তু পাকিস্তান বেছে নেয় আরেক লেগ স্পিনার জাহিদ মাহমুদকে। রাওয়ালপিন্ডিকে সেই টেস্টে নিষ্প্রাণ উইকেটে কোনো প্রভাব রাখতে পারেননি জাহিদ। এবার মুলতানে জাহিদের সঙ্গে জায়গা পান আবরারও। ব্যস, এই সুযোগের অপেক্ষায়ই তো ছিলেন তিনি। চোটের থাবায় ইয়াসির শাহ ক্রমশ বিবর্ণ হয়ে যাওয়ায় বেশ কিছুদিন ধরেই টেস্টে একজন কার্যকর স্পিনার খুঁজছিল পাকিস্তান। জাফর গোহার, নুমান আলি, সাজিদ খান, বাজিয়ে দেখা হয়েছে বেশ কজনকেই। এবার আবরার বার্তা দিলেন, ইয়াসিরের উত্তরসূরি হতে তিনি প্রস্তুত!
আরও পড়ুন
টেস্ট ক্রিকেট: মরণদশা থেকে বাঁচানোর উপায় কী
একটা ধাক্কায় কোহলির ৪ লাখ টাকা জরিমানা
মাশরাফি–সাকিব কি খেলবেন বিপিএলে?