রংপুর ব্যুরো: রংপুর নারীর ওপর দিয়ে বয়ে গেছে শ্যামাসুন্দরী খাল। প্রায় ৩০০ বছর আগে খনন করা খালটি দিয়ে আগে স্বচ্ছ পানি প্রবাহিত হতো। কিন্তু চলতি শতাব্দির প্রথম দিকে দখল-দূষণে রূপ হারাতে শুরু করে। নগরীর বাসিন্দাদের ফেলা আবর্জনা আর বর্জ্যে অস্তিত্ব সংকটে পড়ে খালটি । এর সংস্কারে অন্তত দুই বছর আগে ১৫০ কোটি টাকা খরচও হয়েছে। এমন পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। নতুন করে নেওয়া হয়েছে আরও ১৫ কোটি টাকার প্রকল্প ।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, দখল আর দূষণের পাশাপাশি ময়লা-আবর্জনার ভাগারে পরিণত হয়েছে শ্যামাসুন্দরী। স্থানীয় সরকারসহ সংশ্লিষ্টদের উদাসিনতা। নাগরিকের সমন্বয়হীনতা সচেতনতার অভাবে আশীর্বাদের খালটি অভিশাপে পরিণত হয়েছে। মরণাপন্ন খালটি বাঁচাতে সংস্কারের নামে কোটি কোটি টাকা খরচ করেও তার সুফল মেলেনি। নতুন করে পানি উন্নয়ন বোর্ড প্রকল্প নিলেও কতটা ফলপ্রসূ হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
তবে নদী গবেষক ও সংগঠকরা বলছেন, সমন্বিত উদ্যোগ ছাড়া কোনো প্রকল্পই কাজে আসবে না। তাই দ্রুত সময়ের মধ্যে শ্যামাসুন্দরীকে বাঁচাতে আগে খালটি পুনরুদ্ধার করে বিজ্ঞানসম্মতভাবে খনন ও সংরক্ষণে যথাযথ উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। নয়তো ভবিষ্যতে খালটির অস্তিত্ব সংকটে বিলীন হওয়ার সঙ্গে তীব্র জলাবদ্ধতায় ভোগান্তিতে পড়বে নগরবাসী।
সরেজমিনে দেখা গেছে, পানির প্রবাহ না থাকায় দুর্গন্ধ ছড়ানোর পাশাপাশি মশা-মাছির উপদ্রব বেড়েছে খালপাড়ে। এছাড়া অনেকে পয়ঃনিষ্কাশনের সংযোগ এ খালে দেওয়ায় পানি দূষিত হয়ে পড়েছে। দীর্ঘদিন থেকে সংস্কার না করায় শ্যামাসুন্দরী খালটি নাব্যতা হারিয়েছে। এর দুই পাশ অবৈধভাবে দখল হয়ে যাওয়ায় সংকীর্ণ হয়ে পড়েছে খালটি। বর্তমানে শ্যামাসুন্দরীর কোলঘেঁষে এত অসহ্য দুর্গন্ধ যে এর পাশে মানুষ বাস করতে পারছে না।
এদিকে দীর্ঘদিনেও শ্যামাসুন্দরী রক্ষা ও সংস্কারে কোনো কার্যকর উদ্যোগ না থাকায় নগরবাসীর ক্ষোভ বাড়ছে। পৌরসভা থেকে রংপুর সিটি করপোরেশনে উন্নিত হওয়ার প্রায় দেড় দশক সময় পেরিয়ে গেলেও শ্যামাসুন্দরী খাল এখন জঞ্জালে পরিণত হয়েছে। এক সময়ের স্বচ্ছ পানির এ খাল এখন দুঃস্বপ্নের চেয়েও ভয়ংকর। মশা-মাছি আর পোকা-মাকড়ের প্রজননক্ষেত্রই শুধু নয়, দখল-দূষণেও এই খাল পরিবেশের জন্য এখন মারাত্মক হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০১২ সালে সিটি করপোরেশন হওয়ার আগে দুটি প্রকল্পসহ বিভিন্নভাবে ১২৫ কোটি টাকা ব্যয় শ্যামাসুন্দরীর সংস্কার করা হয়। অথচ এর সুফল পাননি নগরবাসী। সাবেক মেয়র মোস্তফিজার রহমান মোস্তফার সময়ে বলা হয়েছিল নতুন করে আরও ১০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প প্রণয়ণের কাজ চলমান রয়েছে, সেটি বাস্তবায়ন হলে প্রাণ ফিরবে শ্যামাসুন্দরীর।
রংপুর সিটি করপোরেশনের এক কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, খালটি আমরা শুধু পরিষ্কার করে থাকি। কিন্তু এর জন্য বরাদ্দ খুব একটা থাকে না। শ্যামাসুন্দরী খালের সংস্কারে টেকসই উন্নয়ন প্রকল্প প্রয়োজন। তা না হলে ছোট ছোট প্রকল্প দিয়ে এটির সুরক্ষা সম্ভব হবে না। বর্তমানে রংপুর শহরের আকাশ খারাপ হলে গোটা নগরী পানিতে ডুবে যাবে, যার কারণ কয়েক বছর আগে আমরা বুঝতে পেরেছি।
তিনি আরও বলেন, ২০২০ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর ১১ ঘণ্টায় ৪৩৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতে রংপুর নগরীর প্রধান সড়ক, পাড়া-মহল্লার অলিগলিসহ বেশিরভাগ এলাকা তলিয়ে যায়। ঘরবাড়ি, দোকানপাট, মালামাল, খাদ্যশস্যসহ প্রায় অর্ধকোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়। স্থানীয়রা ঘরবাড়ি ছেড়ে গবাদি পশুসহ আশ্রয় নেয় নগরীর স্কুলগুলোতে। এরপরেও খাল নিয়ে তেমন কোনো পদক্ষেপ নেয়নি কেউ। পরের বছর ২০২১ সালের ৩ অক্টোবর ২৪ ঘণ্টায় ২৬৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হলে আবারো ডুবে যায় শ্যামাসুন্দরী নির্ভর রংপুর নগরী।
এদিকে নতুন করে খালটির সংস্কারে ১৫ কোটি টাকার প্রকল্প নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। যেখানে শ্যামাসুন্দরী সংস্কারের পাশাপাশি দুপাশে গাছ লাগানোর পরিকল্পনা করা হয়েছে।
রংপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রধান প্রকৌশলী মাহবুবর রহমান বলেন, প্রথমিকভাবে শ্যামাসুন্দরী পরিষ্কারের পাশাপাশি দুপাশে গাছ লাগানো হবে। এরপর স্টাডি করে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমে শ্যামাসুন্দরীর স্থায়ী সমাধানে কাজ করা হবে।
তবে রিভারাইন পিপলের পরিচালক ড. তুহিন ওয়াদুদ বলেন, শ্যামাসুন্দরী নিয়ে সমন্বিত উদ্যোগ না নেওয়া গেলে এ প্রকল্প কোনো কাজে আসবে না।শ্যামাসুন্দরীর সংস্কার একা জেলা প্রশাসন, সিটি করপোরেশন বা পানি উন্নয়ন বোর্ডের পক্ষে সম্ভব না। এ কাজের জন্য সমন্বিত প্রকল্প নিতে হবে। যেখানে পরিবেশ থেকে শুরু করে সিটি করপোরেশন, এলজিইডিসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে মিলে একটা প্রকল্প নিতে হবে। তবেই কেবল শ্যামাসুন্দরী রক্ষা পেতে পারে।
তিনি আরও বলেন, ঘাঘটের উৎসমুখ তিস্তা নদী থেকে শ্যামাসুন্দরীকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। ফলে শ্যামাসুন্দরী তার নিজস্ব স্রোত হারিয়েছে। এই খালের স্বাস্থ্য সুরক্ষা এখন জরুরি। এজন্য শ্যামাসুন্দরী বাঁচাতে ঘাঘটের উৎসমুখ খুলে দেওয়া, শ্যামাসুন্দরী থেকে অবৈধ দখল উচ্ছেদ করা, দূষণ বন্ধ করা ও বিজ্ঞানসম্মতভাবে খনন করার দাবি জানান তিনি।
প্রসঙ্গত, জলাবদ্ধতা দূর ও ম্যালেরিয়ার হাত থেকে রংপুরকে মুক্ত রাখতে পৌরসভার প্রথম চেয়ারম্যান ও ডিমলার রাজা জানকী বল্ভ সেন ১৮৯০ সালে তার মা চৌধুরানী শ্যামাসুন্দরী দেবীর নামে খালটি পুনঃখনন করেন। ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এ খালের সম্মুখে রয়েছে নগরীর কেলাবন্দের ঘাঘট নদ।
সেখান থেকে শুরু করে নগরীর ধাপ পাশারীপাড়া, কেরানীপাড়া, মুন্সীপাড়া, ইঞ্জিনিয়ারপাড়া, গোমস্তাপাড়া, সেনপাড়া, মুলাটোল, তেঁতুলতলা শাপলা সেতু, নূরপুর, বৈরাগীপাড়া হয়ে মাহিগঞ্জের মরা ঘাঘটের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। এলাকাভেদে এর প্রস্থ ২৩ থেকে ৯০ ফুট ছিল। বর্তমানে শ্যামাসুন্দরী দখল-দূষণের কারণে মৃতপ্রায়।
আরও পড়ুন
আইভীকে বহনকারী পুলিশের গাড়িতে হামলা, ককটেল বিস্ফোরণ
ভাঙ্গুড়ায় নকল দুধ তৈরির কারখানায় অভিযান ও সীলগালা, অনুমতি ছাড়াই আবার চালুর অভিযোগ!
সাভারে বনগাঁও ইউনিয়ন যুবদলের আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত