রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে ২৮ ফেব্রুয়ারি জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন দলটির নেতারাফাইল ছবি:
নিজস্ব প্রতিবেদক: নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টিতে (এনসিপি) যোগ দিয়েছেন গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি ও ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হকের দলের অন্তত ২০ জন নেতা-কর্মী। নুরুল হক দাবি করছেন, এই নেতাদের কয়েকজনকে ‘১০ কোটি টাকা’ ও ‘এমপি’ (সংসদ সদস্য) করার প্রলোভন দেখিয়ে এনসিপিতে নেওয়া হয়েছে। তবে এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন এই অভিযোগকে ‘সর্বৈব মিথ্যা’ বলে আখ্যায়িত করেছেন।
গত ২৮ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে এনসিপির আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশ হয়। অন্তর্বর্তী সরকার থেকে পদত্যাগ করে এই দলের আহ্বায়ক হয়েছেন নাহিদ ইসলাম। নতুন দলের আত্মপ্রকাশের পরদিন ১ মার্চ বিকেলে বিজয়নগরে গণ অধিকার পরিষদের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন ডাকেন নুরুল হক।
ওই সংবাদ সম্মেলনে সরকারে থাকা অন্য দুই ছাত্র উপদেষ্টার পদত্যাগের আহ্বান জানানোর পাশাপাশি নুরুল হক অভিযোগ করেন, জুলাই আন্দোলনকেন্দ্রিক পরিচিত ছাত্রনেতাদের তদবির, নিয়োগ, টেন্ডার-বাণিজ্যসহ নানাবিধ অনৈতিক কর্মকাণ্ডের অসংখ্য ঘটনা ইতিমধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। এমনকি এনসিপির আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানেও জেলা প্রশাসকের নোটিশে ঢাকার অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের মতো বিষয় দেখা গেছে। গাড়ি সরবরাহে মালিক সমিতি ও পরিবহন-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ওপর চাপ প্রয়োগ করা হয়েছে, যা সম্পূর্ণ অনৈতিক ও অগ্রহণযোগ্য।
নুরুলের ওই সংবাদ সম্মেলন ও বক্তব্য প্রসঙ্গে গত রোববার একটি বেসরকারি টেলিভিশনের টক শোতে কথা বলেন এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সমন্বয়ক আবদুল হান্নান মাসউদ। তিনি বলেন, ‘নুরুল হক নুর নিজেই তাঁর দল বিলুপ্ত করে আমাদের (এনসিপি) সঙ্গে যুক্ত হওয়ার আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। আমরা বলেছি, অবশ্যই আদর্শিকভাবে অনেক দিক থেকে আমাদের মিল আছে। কিন্তু আমরা প্রাথমিকভাবে কোনো একটা দল বিলুপ্ত করে আনতে চাইছি না। অনেক ধরনের সমালোচনা হতে পারে। ভবিষ্যতে আমরা একসঙ্গে এক উদ্দেশ্যকে কেন্দ্র করে মুভ দিতে পারি।’
গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক ফাইল ছবি
হান্নানের এই বক্তব্যের জবাবে নুরুল বলেছেন, তিনি এনসিপিতে যোগ দিতে চাননি; বরং এনসিপির নেতাদের তিনি গণ অধিকার পরিষদে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নুরুল হকের দল গণ অধিকার পরিষদ ও দলটির ছাত্রসংগঠন ছাত্র অধিকার পরিষদের অন্তত ২০ জন নেতা এনসিপিতে যোগ দিয়েছেন, আহ্বায়ক কমিটিতে তাঁরা পদ পেয়েছেন। এঁদের মধ্যে গণ অধিকার পরিষদের গুরুত্বপূর্ণ পদে ও ভূমিকায় ছিলেন এমন নেতারাও রয়েছেন। এই নেতাদের একটি অংশ গত বছরের ৫ আগস্টের আগে এবং আরেকটি বড় অংশ ৫ আগস্টের পরে নুরুল হকের সঙ্গ ছেড়েছে।
এনসিপি নেতাদের অনেকে মনে করছেন, নিজ দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতারা এনসিপিতে যোগ দেওয়ায় বড় ধরনের সংকটে পড়েছে নুরুলের দল। এ কারণে নুরুল এনসিপি নেতাদের বিরুদ্ধে কথা বলছেন।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র আরও জানায়, নুরুল হক ছাত্র-তরুণদের নতুন দলের সঙ্গে যুক্ত হতে চান বলেও আলোচনা ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটা হয়নি। এরই মধ্যে তাঁর সহচরেরা নতুন দলে চলে গেছেন। সব মিলিয়ে নুরুল হক এখন এনসিপি নেতাদের ওপর চটেছেন।
নুরুল হক এখন ইউরোপ সফরে। গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, নতুন দলের উদ্যোক্তাদের অনেকেই তাঁর দল (গণ অধিকার পরিষদ) ও সংগঠনের কর্মী বা দ্বিতীয় ও তৃতীয় সারির নেতা ছিলেন। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর একটি বৃহত্তর প্ল্যাটফর্ম করার ব্যাপারে তাঁদের সঙ্গে তাঁর (নুরুলের) সঙ্গে আলোচনাও হয়েছে। কিন্তু কারও কারও দূরদর্শিতার অভাব থাকায় সেটি আর এগোয়নি।
নুরুল হক অভিযোগ করে বলেন, ‘নতুন দলের উদ্যোক্তারা আমাদের দলের অনেককে তাঁদের দলে যোগ দেওয়ার জন্য ১০ কোটি টাকা ও এমপি বানানোর অফার দিয়েছেন। এনসিপির নেতাদের পাশাপাশি এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত কোনো উপদেষ্টার পক্ষ থেকে এ ধরনের প্রলোভন দেখিয়েছেন। এর কারণে আমাদের কয়েকজনের মধ্যে দ্বিধা ছিল।’
নুরুল দাবি করেন, তাঁর দলের উচ্চতর পরিষদের সদস্য আবু হানিফসহ কয়েকজনকে এভাবে বিভ্রান্ত ও ‘ব্ল্যাকমেল’ করে এনসিপিতে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু পরে তাঁরা ভুল বুঝতে পেরে গণ অধিকার পরিষদে ফিরে এসেছেন।
এ বিষয়ে গতকাল রাতে আবু হানিফের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তাঁদের কাউকে কোনো টাকার প্রলোভন দেখানো হয়নি। তবে তিনি বলেন, ‘এনসিপি বেটার কিছু হবে মনে করে আমি এই দলে যোগ দিয়েছিলাম। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে গণ অধিকার পরিষদে থেকেই ভালো কাজ করতে পারব। তাই আমি গণ অধিকারে ফিরে যাচ্ছি। শিগগিরই আমি এনসিপি থেকে পদত্যাগ করব। তবে গণ অধিকার থেকে এনসিপিতে যাওয়া অন্যদের কথা আমি বলতে পারছি না।’
এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন ছবি: সংগৃহীত
এদিকে দলে নিতে ১০ কোটি টাকা ও এমপি পদের প্রলোভন দেখানোর যে অভিযোগ নুরুল হক করছেন, সে বিষয়ে এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন বলেন, ‘এটা সর্বৈব মিথ্যা একটা অভিযোগ। এর কোনো ধরনের ভিত্তি নেই। এ ধরনের কথা বলার আগে প্রমাণ সাপেক্ষে বলা উচিত। প্রমাণ ছাড়া এ ধরনের মন্তব্য করা পুরোনো সংস্কৃতির অংশ। এটা যেকোনো রকমের একটা বক্তব্য দিয়ে রাজনৈতিক ধোঁয়াশা তৈরি করে বেনিফিট নেওয়ার চেষ্টা।’
এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার বলেন, ‘গণ অধিকার পরিষদ থেকে আমাদের দলে যাঁরা এসেছেন, তাঁদের বেশির ভাগই বহু আগে ওই দল ছেড়েছেন। নুরুল হকের ব্যক্তিগত অনেকগুলো কর্মকাণ্ড ও ভুল রাজনীতির কারণে তাঁদের অনেকেই একটা নতুন রাজনীতি চাইছিলেন। সেই রাজনীতির কথা যখন এনসিপি প্রস্তাব করেছেন, তখন তাঁরা এই দলে এসেছেন। নুরুল হক যেসব কথা বলছেন, সেগুলো তিনি প্রমাণ করতে পারবেন না। এগুলো খুব দায়িত্বজ্ঞানহীন কথাবার্তা।’
নুরুলের দলের কারা কারা এনসিপিতে
নুরুল হকের গণ অধিকার পরিষদের উচ্চতর পরিষদের সদস্য ও গণমাধ্যম সমন্বয়ক ছিলেন আবু হানিফ। এনসিপিতে যোগ দিয়ে তিনি দলটির যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক হয়েছেন। নুরুলের দলের উচ্চতর পরিষদের সদস্য হানিফ খান সজীব, আব্দুজ জাহের ও আরিফুল ইসলামও যোগ দিয়েছেন এনসিপিতে। এর মধ্যে সজীব এনসিপির যুগ্ম মুখ্য সংগঠক, জাহের যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক ও আরিফুল দক্ষিণাঞ্চলের সংগঠক হয়েছেন।
গণ অধিকার পরিষদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মশিউর রহমান এনসিপির যুগ্ম সদস্যসচিব হয়েছেন। গণ অধিকার পরিষদের ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক মো. রাসেল আহমেদ এনসিপির দক্ষিণাঞ্চলের সংগঠকের পদ পেয়েছেন। গণ অধিকার পরিষদের সহযোগী সংগঠন পেশাজীবী অধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মো. নিজাম উদ্দিনও এনসিপিতে যোগ দিয়েছেন। তিনি নতুন দলের যুগ্ম সদস্যসচিব। নুরুল হকের দলের ছাত্রসংগঠন ছাত্র অধিকার পরিষদের বেশ কয়েকজন নেতাও যোগ দিয়েছেন এনসিপিতে। এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়কের দায়িত্ব পাওয়া আরিফুল ইসলাম আদীব ছাত্র অধিকার পরিষদের সাবেক সাধারণ সম্পাদক। যুগ্ম সদস্যসচিব আকরাম হুসেইন ছাত্র অধিকার পরিষদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাবেক সাধারণ সম্পাদক।
আরও পড়ুন
চেয়ারম্যান-কমিশনারের পদত্যাগের দাবিতে বিএসইসিতে কর্মবিরতি
অর্থ পাচার মামলায় সাজার রায় বাতিল, খালাস পেলেন তারেক-মামুন
ইউক্রেনকে গোয়েন্দা তথ্য দেওয়া বন্ধ করল যুক্তরাষ্ট্র