দেশের মাঠ পর্যায়ে প্রশাসনে ‘শুদ্ধি অভিযান’ চালানো হবে। প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে যেসব কর্মকর্তারা গত ১৬/১৭ বছর ধরে ভালো পদায়ন পাননি, তাদের মূল্যায়ন করা হবে। সরিয়ে দেওয়া হবে রাজনৈতিক সুবিধাভোগী কর্মকর্তাদের।
জনপ্রশাসন ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারা গণমাধ্যমকে জানান, টানা ১৫ বছর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে প্রশাসনে ব্যাপক দলীয়করণ করা হয়েছে। প্রশাসনের সব স্তরে দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ ও পদায়ন করা হয়েছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর প্রশাসনের বিভিন্ন স্তর থেকে তাদের সরানো হচ্ছে। এবার মাঠ প্রশাসনেও এ শুদ্ধি অভিযান পরিচালনা করা হবে।
আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর এরইমধ্যে মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন বিভাগ বা প্রশাসনের দপ্তর ও সংস্থা প্রধানসহ বিভিন্ন স্তরের দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের অপসারণ চলছে। পাশাপাশি যারা আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নিয়োগ বা পদোন্নতি সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছিল তাদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ ও পদায়ন করা হচ্ছে।
এরই মধ্যে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে পদোন্নতিবঞ্চিত অবস্থায় অবসরে যাওয়া পাঁচজন অতিরিক্ত সচিবকে চুক্তিতে সচিব পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ, জননিরাপত্তা বিভাগ, রেলপথ মন্ত্রণালয় ও রাষ্ট্রপতি কার্যালয়ের জন বিভাগের সচিব হিসেবে তাদের নিয়োগ দিয়ে গত শনিবার (১৭ আগস্ট) জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সূত্রে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ পাওয়া বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদেরও (ইউএনও) সরিয়ে দেওয়া হতে পারে। দলীয় সুবিধাভোগী কর্মকর্তাদের অপসারণের জন্য চলছে তালিকা তৈরির কাজ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক উচ্চ পর্যায়ের একাধিক কর্মকর্তা জানান, রাজনৈতিক দলীয়করণে আওয়ামী শাসনামলে প্রশাসনে পদোন্নতি বঞ্চিত হয়েছেন শত শত কর্মকর্তা। দলীয় লোকজনকে করে ভালো ভালো জায়গায় পোস্টিং দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও মাঠ প্রশাসনে সরকার অনুগত বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের (ইউএনও) পদায়ন করা হয়েছে।
দলীয় কর্মকর্তাদের সরিয়ে দিয়ে সৎ ও দক্ষ কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়ার জন্য কাজ চলছে। এতে করে সংস্কার ইস্যুতে অন্তর্বর্তী সরকারের যে লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে, তাও বাস্তবায়ন সহজ হবে বলেও মনে করেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
তারা আরও মনে করেন, আওয়ামী সরকারের আমলে দলীয়করণে গত ১৭ বছর প্রশাসনে যারা পদোন্নতিবঞ্চিত ছিল, বিশেষ করে বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত কর্মকর্তাদের ক্ষোভ-অসন্তোষ কমানোর জন্যই এই পদোন্নতি ও চুক্তিতে নিয়োগ বা পদায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
কর্মকর্তারা জানান, যেসব কর্মকর্তা বিএনপি-জামায়াত ঘরানার, তাদের ভালো পোস্টিং থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। গোয়েন্দা তদন্ত প্রতিবেদনে তাদের নামের সঙ্গে ‘নেগেটিভ’ উল্লেখ থাকায় বঞ্চিত করা হয়। অনেককে বছরের পর বছর ওএসডি থাকতে হয়েছে অথবা গুরুত্বহীন পদে ফেলে রাখা হয়েছে। অনেককে বাধ্যতামূলক অবসরেও পাঠানো হয়েছে। যেসব কর্মকর্তারা গত ১৭ বছর ধরে ভালো জায়গায় পোস্টিং পাননি, তাদের এখন মূল্যায়ন করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আওয়ামী লীগের টানা ১৫ বছরের আমলে দলীয় বিবেচনায় অনেক দলবাজ কর্মকর্তাকে নিয়োগ ও পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে, যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও অনেককে নিয়োগ ও পদোন্নতি বঞ্চিত করা হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘প্রশাসনের সব স্তরে শুদ্ধি অভিযান পরিচালনা করা জনমানুষের দাবি। এ দাবি পূরণে অন্তর্বর্তী সরকার কাজ করে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে কেন্দ্রীয় প্রশাসনে শুদ্ধি অভিযান চলছে। মাঠ প্রশাসনেও দ্রুতই এ অভিযান শুরু হবে। এসব অভিযানের ফলে অন্তর্বর্তী সরকারের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সহজ হবে।’
এদিকে, সচিব বা দপ্তর প্রধান হিসেবে যারা চুক্তিতে নিয়োগ পেয়েছিলেন তাদের চুক্তিও বাতিল করা হয়েছে।
বিভিন্ন অভিযোগ থাকায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব মো. জাহাংগীর আলমকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। অন্যদিকে, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থার ১০ জন সচিব ও সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগও বাতিল করা হয়েছে। তাদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে।
চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল হওয়া কর্মকর্তারা হলেন- অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সিনিয়র সচিব ও এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম, বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) চেয়ারম্যান মো. লোকমান হোসেন মিয়া, জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের সচিব কে এম আব্দুস সালাম, পরিকল্পনা বিভাগের সিনিয়র সচিব সত্যজিৎ কর্মকার, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোকাম্মেল হোসেন, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরী, রেলপথ মন্ত্রণালয় সচিব মো. হুমায়ুন কবীর, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আলী হোসেন, কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব ওয়াহিদা আক্তার, বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী সদস্য (সচিব) মোহাম্মদ খায়রুল ইসলাম।
এছাড়াও বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক (ডিজি) ড. মো. হারুন-উর-রশিদ আসকারী, বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ, শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকীর চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করা হয়।
জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্রের পরিচালক মিনার মনসুর ও ভারত মিশনের প্রেস উইংয়ের কলকাতার বাংলাদেশ উপহাইকমিশনের প্রথম সচিব (প্রেস) রঞ্জন সেনের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগও বাতিল হয়।
পর্যায়ক্রমে চুক্তিভিত্তিক নিয়োজিত অন্যান্য কর্মকর্তাদের নিয়োগও বাতিল করা হবে বলে জানা গেছে।
এছাড়াও পদত্যাগ করেছেন অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধানরা।
—–ইউএনবি
আরও পড়ুন
ডেঙ্গুতে একদিনে ৫ মৃত্যু, হাসপাতালে ১০৩৪ রোগী
মুজিববর্ষের বাজেট বরাদ্দ বাতিল করলো অন্তর্বর্তী সরকার
নির্বাচনে আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করতে পূর্ণ ক্ষমতা চায় ইসি