জেলা প্রতিনিধি, মৌলভীবাজার:
গত এক সপ্তাহ আগে ভারত থেকে নেমে আসা ঢল ও ভারী বৃষ্টির কারণে সৃষ্ট বন্যার পানি কমার পর স্পষ্ট হয়ে উঠছে ক্ষয়-ক্ষতির চিত্র। আকস্মিক ওই বন্যায় পানির স্রোতে ভেঙে গেছে শত শত মানুষের ঘড়বাড়ি ও এলাকার রাস্তাঘাট। ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে শত শত একর কৃষিজমিও। বন্যার পানি কমলেও দুর্গত মানুষের দুর্ভোগ এখনো কাটেনি। ঘরবাড়ি হারিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন বন্যা কবলিত এলাকার কয়েক হাজার মানুষ। এমন চিত্র মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার টিলাগাঁও ইউনিয়নের।
এবারের আকস্মিক বন্যায় উপজেলার মধ্য সবচেয়ে বেশি বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে টিলাগাঁও ইউনিয়নের মিয়ারপাড়া, হাজীপুরসহ বেশ কয়েকটি এলাকা। এ যেন যুদ্ধবিধ্বস্ত একখন্ড ভূমি। সৃষ্ট বন্যায় ইউনিয়নের প্রায় তিন শতাধিক পরিবারের বসতঘর পুরোপুরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বন্যার পানি কমে গেলেও ক্ষতিগ্রস্থ অনেক লোকই তাদের আপন গৃহে এখনো উঠতে পারেননি। অনেকেই মনু নদীর পাড়ে উঁচু জায়গায় অস্থায়ী ঝুঁপড়ি ঘর তৈরি করে সেখানে আশ্রয় নিয়েছেন। অনেকে পরিবার এখনো তাদের আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িতে রয়েছেন। এছাড়া তাদের একমাত্র সম্বল গৃহপালিত গরু, মহিষ ও ছাগল নদীর পাড়ে রেখেছেন। যাদের ঘর বন্যায় পুরোপুরি বিলীন হয়েছে তারা বেশিরভাগই দরিদ্র পরিবার। এখন তাঁরা প্রত্যেকেই ঘর মেরামত করে বসবাসের উপযোগী করার জন্য সরকারি-বেসরকারি সহায়তা পাওয়ার আশায় পথ চেয়ে বসে রয়েছেন। বন্যার আগে ওইসকল মানুষের ঘরবাড়ি সব ছিল। সর্বনাশা বন্যায় তাদের সব ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। বুধবার বিকেলে সরেজমিনে বন্যা কবলিত টিলাগাঁও ইউনিয়নের মিয়ারপাড়া, হাজীপুর গ্রামে গেলে এমন দুর্দশার চিত্র দেখা যায়।
বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থরা জানান, অনেকে স্বপ্নের রোপা আমন ধান ও সবজি ক্ষেত চাষ করলেও বানের পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় তারা বেশ দুশ্চিন্তায় পড়েছেন। বন্যায় সর্বশান্ত কৃষক, মৎস্যজীবী, শ্রমজীবী ও নিম্নআয়ের দরিদ্র মানুষ পড়েছেন এখন চরম বিপাকে। তাদের ঘর মেরামতে কেউ এগিয়ে আসছে না। ঘর মেরামত করার জন্য তাদের কোন সামর্থ্য নেই। তারা আক্ষেপ করে বলেন, ত্রাণ নয় এখন পুনর্বাসন চান।
সরেজমিনে দেখা যায়, উপজেলার টিলাগাঁও ইউনিয়নের মিয়ারপাড়া গ্রামে ২০-২৫টি ঘর পুরো পুরো বিধ্বস্ত ও ১৫-১৬টি ঘর আংশিক ক্ষতি হয়েছে। গ্রামের হতদরিদ্র বিধবা মহিলা তরিবুন বেগম (৪৫) নদীর পাড়ে বাঁধের উপর দাঁড়িয়ে আছেন। জিজ্ঞেস করলে তিনি জানান, অনেক আগে স্বামীকে হারিয়ে ১৬ বছরের একমাত্র ছেলেকে নিয়ে আমার দুঃখের সংসার। স্বামী মারা যাবার পর বিভিন্ন মানুষের বাড়িতে গৃহপরিচারিকার কাজ করে কোনমতে দিনাতিপাত করছেন। ছেলে এতিমখানায় থেকে পড়াশোনা করছে। এরপরে মরার উপর খরার ঘা। চলতি বন্যায় তার মাটির ঘর পুরোপুরি ভেঙ্গে গেছে। ওই ঘরটি মেরামত করার মতো কোন অর্থ নেই তার। তাকে ঘর নির্মাণে সহযোগিতা করতে সরকারসহ সমাজের বিত্তবানদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন ক্ষতিগ্রস্থ তরিবুন বেগম।
একই গ্রামের মহরম উল্লার ছেলে সিএনজি চালক সুজন মিয়া জানান, মিয়ারপাড়ার যে স্থান দিয়ে প্রায় ৫০০ ফুট বাঁধ ভেঙ্গেছে ওই বাঁধের নীচে আমাদের ছয় ভাইয়ের পাকার ঘর ছিল। তিন ভাইয়ের পাকা ঘরটি বন্যার পানিতে বিলীন করে নিয়েছে এবং আমাদের আরো তিন ভাইয়ের ঘরের সিংহভাগ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।
দিনমজুর শামীম আহমদ বলেন, বন্যায় আমার কাঁচা ঘরটি ভেঙ্গে গেলে পানির ভয়াবহ স্রোতে ঘরের উপরের টিনের চালা ভাসিয়ে নিয়ে যায়। মাটির ঘরটি একদম বিলীন হয়ে যায়। এখন খুবই অসহায় হয়ে পড়েছে। আমার বাবা একবছর ধরে অসুস্থ। তিনি সুস্থ থাকাবস্থায় কৃষিকাজ করে আমাদের পরিবার চালাতেন। এখন কে করবে আমাকে সাহায্য। আমি সরকারের কাছে পুনর্বাসনের জন্য সহায়তা কামনা করছি। শামীমের পাশের ঘর ছিল আরেক দিনমজুর রহুল মিয়ার। ৪ জনের পরিবার খুবই কষ্ট করে চলছিল কিন্তু বন্যায় ওই কাঁচা ঘরটিও পানির সাথে বিলীন হয়ে যায়।
এভাবে মিয়ারপাড়া গ্রামের জমসেদ আলী, ছালিক মিয়া, তোয়াব আলী, আমির উদ্দিন, লিলই বেগমের ঘরসহ অনেকের ঘর ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। এদিকে হাজীপুর গ্রামের রুনা বেগম, বাবুল মিয়া, ফয়জু মিয়া, আজিজুল মিয়া, রাজা মিয়া, হারুন মিয়া, জলাল মিয়া, ইন্তু মিয়া, মজই মিয়া, সাইমুল্লাহ, লতিফ মিয়াসহ ২৫-৩০টি মাটি ও বেড়ার তৈরি কাঁচা ঘর বন্যার পানিতে বিলীন হয়ে গেছে। তারা সবকিছু হারিয়ে এখন নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন। দুর্গত এলাকার ক্ষতিগ্রস্থ মানুষ চলমান এই কঠিন দুর্যোগে তাদের ঘর পুনঃনির্মাণে সহায়তা দিয়ে পাশে দাঁড়ানোর জন্য সকলের কাছে আকুল আবেদন জানিয়েছেন।
আরও পড়ুন
খুলনা বিভাগে ভোক্তা-অধিকারের অভিযান : ১৭টি প্রতিষ্ঠানকে ২ লাখ ২২ হাজার টাকা জরিমানা
খুবিতে ‘উচ্চ শিক্ষায় অ্যাক্রেডিটেশন’ বিষয়ে উদ্বুদ্ধকরণ কর্মশালার উদ্বোধন
তালতলীতে ১০টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা