December 28, 2024

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Monday, October 7th, 2024, 1:37 am

জেন জি প্রজন্মে  শিক্ষকতা

ড. ইলিয়াছ প্রামাণিক, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক:

জেন জি প্রজন্ম, যারা ১৯৯৭ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে জন্মগ্রহণ করেছে, প্রযুক্তি নির্ভর জীবনের কারণে শিক্ষার ক্ষেত্রে বিভিন্ন পরিবর্তনের মধ্যে বেড়ে উঠেছে। এই প্রজন্মের শিক্ষার্থীরা ডিজিটাল প্রযুক্তির মাধ্যমে শেখার প্রতি অত্যন্ত আগ্রহী এবং তাদের দৃষ্টিভঙ্গি, চিন্তাভাবনা এবং শেখার পদ্ধতি বহুলাংশে ভিন্ন। এই  পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে, বাংলাদেশে শিক্ষক ও শিক্ষকতার গুণাবলির গুরুত্ব অপরিসীম। শিক্ষা সম্পর্কে মহাত্মা গান্ধী তাঁর বই Education as a Tool for Social Change” (1937)-এ উল্লেখ করেছেন, “শিক্ষা হল এমন একটি মাধ্যম, যা মানুষের মনন ও মুল্যবোধ গঠনে সাহায্য করে।” গান্ধী বিশ্বাস করতেন, “শিক্ষা হল একটি সর্বজনীন অধিকার যা প্রতিটি মানুষের জন্য প্রবেশযোগ্য হওয়া উচিত।” তাঁর মতে, শিক্ষা কেবলমাত্র জ্ঞানার্জন নয়, বরং এটি চরিত্র গঠনের মাধ্যম এবং সমাজের নৈতিক ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে থাকে। বর্তমান বাংলাদেশ সরকারের প্রধান উপদেষ্টা  অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনুস তাঁর বই “A World of Three Zeroes: The New Economics of Zero Poverty, Zero Unemployment, and Zero Net Carbon Emissions” (২০১৭)-এ দারিদ্র্য, বেকারত্ব এবং পরিবেশগত সংকট মোকাবিলার জন্য নতুন অর্থনৈতিক মডেল উপস্থাপন করেছেন। এই বইয়ে তিনি উল্লেখ করেছেন যে, একটি ন্যায়সঙ্গত এবং টেকসই ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার জন্য শিক্ষা কীভাবে একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে ভূমিকা রাখতে পারে। এই প্রেক্ষাপটে, জেনারেশন জেড শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষকের দায়িত্ব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এই প্রজন্মই ভবিষ্যত উন্নয়নের চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করবে। অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনুস শিক্ষার সাথে তার এই অর্থনৈতিক মডেলের যে মেলবন্ধন দেখিয়েছেন তাতে এটা পরিষ্কার যে বর্তমান শিক্ষা বন্দবাস্তে শিক্ষকদের কিছু গুণাবলী থাকা আবশ্যক।  বর্তমান জেন জি প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষক হিসেবে যারা কাজ করবেন, তাদের নৈতিক মূল্যবোধ, সৃজনশীলতা এবং প্রযুক্তিগত দক্ষতার সমন্বয় থাকা অত্যন্ত জরুরী।

বর্তমান সময়ে, ৪র্থ শিল্পবিপ্লব (4IR) এমন একটি পরিবর্তনশীল দুনিয়ার পরিচায়ক, যেখানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI), রোবোটিক্স, ইন্টারনেট অফ থিংস (IoT), এবং ব্লকচেইন প্রযুক্তি আমাদের জীবনযাত্রা এবং কাজের ধরনকে পুরোপুরি বদলে দিচ্ছে। জেন জি প্রজন্ম এইসব প্রযুক্তি নির্ভর টুলসগুলোতে খুবেই আসক্ত। তাই এই পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে এবং ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় জেন জির শিক্ষকদের ডিজিটাল প্রযুক্তিতে দক্ষ হতে হবে। স্যার কেন রবার্টসন তাঁর বই “Creative Schools: The Grassroots Revolution That’s Transforming Education” (২০১৫)-এ বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন যে, “শিক্ষকদের প্রযুক্তি ব্যবহারের দক্ষতা শিক্ষার্থীদের শেখার পরিবেশকে সম্পূর্ণরূপে পরিবর্তন করতে পারে।” শিক্ষকদের প্রযুক্তিগত দক্ষতা ছাড়া শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যতের জন্য যুগপযুগীভাবে  প্রস্তুত করা বর্তমান যুগে প্রায় অসম্ভব। স্যার কেন রবার্টসনের মতে, শিক্ষকেরা যদি প্রযুক্তির ব্যবহারকে কৌশলগতভাবে শ্রেণীকক্ষের অভিজ্ঞতার সাথে মিশিয়ে দিতে পারেন, তাহলে শিক্ষার্থীদের শেখার আগ্রহ ও সম্পৃক্ততা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাবে। যেমন, ভার্চুয়াল রিয়েলিটি (VR), অগমেন্টেড রিয়েলিটি (AR), এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) ব্যবহার করে শিক্ষাদানকে আরও উদ্ভাবনী এবং প্রাসঙ্গিক করা সম্ভব ।

এদিকে শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রযুক্তি নির্ভরতা থাকার ফলে শিক্ষকদের জন্য একটি নতুন দায়িত্ব সৃষ্টি হয়েছে, যা হলো শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা বাড়াতে সহায়তা করা। গান্ধীর শিক্ষা দর্শনের সাথে সঙ্গতি রেখে শিক্ষকদের কাজ হচ্ছে এমন একটি পরিবেশ তৈরি করা, যেখানে শিক্ষার্থীরা তাদের চেতনা ও কল্পনাশক্তি বাড়াতে পারে। এটি শিক্ষাদানকে শুধুমাত্র পাঠ্যক্রমের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে একটি বহুমাত্রিক শিক্ষার অভিজ্ঞতা প্রদান করবে। উদাহরণস্বরূপ, প্রকল্প-ভিত্তিক শিক্ষাদানের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের বাস্তব জীবনের সমস্যা সমাধানের জন্য প্রস্তুত করা যেতে পারে, যা তাদের চিন্তাশক্তি ও সমস্যার সমাধান করার ক্ষমতাকে উন্নত করবে। অর্থাৎ, বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষকদের শুধুমাত্র প্রযুক্তিগত জ্ঞান অর্জনই নয়, বরং মানবিক মূল্যবোধ ও সৃজনশীলতা বিকাশে কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে। প্রযুক্তি ব্যবহার করে শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের যে সুযোগ-সুবিধা দিতে পারেন, তা শিক্ষার প্রক্রিয়াকে শুধুই সহজ করে তোলে না, বরং এটি শিক্ষার্থীদের চেতনা ও সামাজিক দায়বদ্ধতা বৃদ্ধিতে সহায়ক ভুমিকা পালন করে।

জেনারেশন জেড প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বেগ ও চাহিদা বোঝার জন্য শিক্ষকদের সহানুভূতি ও আবেগী বুদ্ধিমত্তা থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান যুগে, বিভিন্ন সামাজিক ও প্রযুক্তিগত প্রভাবের কারণে শিক্ষার্থীদের মানসিক চাপ, উদ্বেগ এবং হতাশার হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটি তাদের শৈক্ষিক প্রক্রিয়া এবং ব্যক্তিগত বিকাশে প্রভাব ফেলছে। ফলে, শিক্ষকদের একটি আবেগী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে শিক্ষার্থীদের অবস্থা অনুধাবন করা এবং তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা পালন করা আবশ্যক। শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য উন্নয়নে শিক্ষকদের কৌশলগতভাবে পরামর্শ এবং সহায়তার সুযোগ থাকতে হবে। যেমন, শিক্ষার্থীদের আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধির জন্য তাদের সাফল্য ও প্রচেষ্টার প্রশংসা করা, ক্লাসে গঠনমূলক মতামত প্রদান করা, এবং মানসিক চাপে থাকা শিক্ষার্থীদের পরামর্শদাতা বা পেশাদার মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের কাছে পাঠানো। মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়টি স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত একটি প্রধান অগ্রাধিকার হওয়া উচিত, যাতে শিক্ষার্থীরা তাদের চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে সক্ষম হয়।

ড. গ্লোরিয়া লাডসন-বিলিংস তাঁর বই Culturally Responsive Teaching (২০১৪)-এ দেখিয়েছেন যে, বৈচিত্র্যময় শিক্ষার পরিবেশে শিক্ষার্থীরা তাদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক পরিচয়ের প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং দায়িত্বশীল হয়ে ওঠে। তিনি বলেন, “যখন শিক্ষার্থীরা তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি, ভাষা, এবং পরিচয়ের প্রতি সম্মানিত ও মুল্যায়িত বোধ করে, তখন তারা শিক্ষায় আরও সম্পৃক্ত হয়।” ফলে, শিক্ষার এই ধরনের পরিবেশ শিক্ষার্থীদের আত্মবিশ্বাস বাড়াতে এবং তাদের মেধার পূর্ণ বিকাশে সহায়তা করতে পারে। তাই  জেনারেশন জেডের শিক্ষার্থীদের জন্য বৈচিত্র্যময় শিক্ষার পরিবেশ তৈরি করা শিক্ষকদের একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। বর্তমান শিক্ষার্থীদের মাঝে বৈচিত্র্যকে গুরুত্ব দেওয়া এবং সম্মান করা তাদের শেখার অভিজ্ঞতাকে আরও অর্থবহ করে তুলতে পারে। এই বৈচিত্র্যের সঠিক মূল্যায়নের জন্য শিক্ষকদের সংস্কৃতিগতভাবে সংবেদনশীল শিক্ষাদান পদ্ধতি গ্রহণ করতে হবে।

সমাজের উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতার জন্য এই প্রজন্মের শিক্ষকদের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। জেনারেশন জেড শিক্ষার্থীদের জন্য এই ভূমিকা আরও গভীর এবং তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ এই প্রজন্মের হাতে রয়েছে ভবিষ্যতের দায়ভার। বৈচিত্র্য, প্রযুক্তি, নৈতিক মূল্যবোধ এবং মানসিক স্বাস্থ্যএই চারটি স্তম্ভে শিক্ষকদের তাদের শিক্ষাদানের ভিত্তি গড়ে তুলতে হবে। শিক্ষার সাথে সামাজিক ন্যায়বিচার, মানসিক স্বাস্থ্য উন্নয়ন এবং সংস্কৃতিগত সংবেদনশীলতার সমন্বয়ে, শিক্ষকরা একটি প্রজন্মকে শুধু শিক্ষিতই নয়, বরং তাদেরকে বিশ্বনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে সক্ষম হবেন।

লেখক: বিভাগীয় প্রধান, কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।

[email protected]