December 28, 2024

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Sunday, October 13th, 2024, 10:29 pm

সিঁদুর খেলা ও মিষ্টিদানের পর প্রতিমা বিসর্জনের প্রস্তুতি

নিজস্ব প্রতিবেদক
ঝকঝকে নতুন কাঁসার থালার ওপরে ছোট ছোট বাটি গোল করে সাজানো। বাটিগুলোও কাঁসার। সেই বাটিতে ধান, দুর্বা, ফুলের পাপড়ি, তেল, নাড়ু, পান, সুপারি এই সপ্ত উপাচারের সঙ্গে মাঝখানে একটু বড় আকারের আরেক বাটিতে আছে সিঁদুর। সপ্ত উপাচারে সাজানো নৈবেদ্যর থালাটি দেবী দশভুজার চরণতলে নিবেদন করে করেছেন আঁখি দে। তারপর সিঁদুরের বাটি থেকে খানিকটা সিঁদুর দেবীর চরণে স্পর্শ করে নিজের কপালে-কপোলে মেখে মন্দিরের মণ্ডপের ভিড় ঠেলে বেরিয়ে এলেন তিনি।

আজ বেলা সাড়ে ১১টার দিকে সিদ্ধেশ্বরী কালীমন্দিরে বিজয়ার সিঁদুর খেলায় অংশ নেন রাজধানীর শাজাহানপুরে বাসিন্দা এই দেবী ভক্ত।

মহা ধুমধামের মধ্যে দিয়ে পাঁচ দিনের পূজা-অঞ্জলি-আরতির পর আজ রোববার প্রতিমা বিসর্জনের মধ্যে দিয়ে শেষ হচ্ছে বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা। সাধারণত দশমী বিহিত পূজার পর বিসর্জনের আয়োজন থাকে। তবে আগেই জানানো হয়েছিল, এবার পঞ্জিকামতে গতকাল শনিবার ভোরে নবমী তিথি এবং সন্ধ্যার পর থেকে দশমী তিথি শুরু হওয়ায় একই দিনে নবমী ও দশমীর বিহিত পূজা। সব আচার শেষে প্রতিমা বিসর্জনের প্রস্তুতি শুরু করা হবে।

দশমীর পূজা শেষে প্রতিমা বিসর্জনের রীতি থাকলেও গভীর রাতে বিসর্জন সম্ভব হবে না বলে দর্পণ বিসর্জনের মধ্যে দিয়ে পূজার ধর্মীয় আচার সম্পন্ন হচ্ছে। আজ রোববার বেলা ১১টা থেকে মন্দিরে মন্দিরে বিবাহিত নারীরা অংশ নেন সিঁদুর খেলা ও মিষ্টি দানের আয়োজনে।

রাজধানীতে সকাল থেকেই বিসর্জনের প্রস্তুতির পাশাপাশি সিঁদুর খেলার আয়োজন শুরু হয়ে যায়। বিবাহিত নারীদের সঙ্গে তাঁদের স্বামী-সন্তানেরা এবং অনেক ভক্ত এবারে উৎসবে শেষবারের মতো দেবীকে প্রণাম জানাতে মন্দিরে মন্দিরে সমবেত হন।
সিদ্ধেশ্বরী কালীমন্দির কমিটির পূজা সম্পাদক উত্তম কুমার শীল প্রথম আলোকে বলেন, চার শতাব্দীরও অধিক প্রাচীন ঢাকার এই ঐতিহ্যবাহী মন্দিরে বাহুল্য আড়ম্বর ছাড়া পুরোপুরি সাত্ত্বিক রীতিতে দেবীর পূজা হয়। এবার পূজায় প্রতিদিন ৩ হাজার মানুষের মধ্যে প্রসাদ বিতরণ, বহু দরিদ্র মানুষের মধ্যে বস্ত্র বিতরণ এবং ফেনীতে বন্যা দুর্গতদের জন্য বস্ত্র বিতরণ করা হয়েছে। এ ছাড়া মন্দিরের চারপাশের সিদ্ধেশ্বরী মহল্লার ধর্মবর্ণনির্বিশেষে প্রতিটি বাসাবাড়িতে পূজার প্রসাদ উপহার হিসেবে পাঠানো হয়েছে। খুব শান্তিপূর্ণ পরিবেশে এবার পূজা হয়েছে, অংশগ্রহণকারী ভক্তের সংখ্যাও ছিল বেশি বলে জানালেন তিনি।

সিদ্ধেশ্বরী মন্দিরে মণ্ডপের সামনে সাউন্ড সিস্টেমে একের পর এক গান বেজে যাচ্ছিল। দেবীর চরণে সিঁদুর স্পর্শ করে অনেকেই, বিশেষ করে অল্পবয়সীরা গানের তালে তালে নৃত্য করছিলেন। পুরান ঢাকার টিকাটুলি থেকে এখানে সিঁদুর খেলায় অংশ নিতে এসেছিলেন সাধনা চক্রবর্তী, স্বামী পার্থ চক্রবর্তীও ছিলেন সঙ্গে। সাধনা বললেন, স্বামী-সন্তানের মঙ্গল কামনার পাশাপাশি সবার জন্যই শান্তির প্রার্থনা করেছেন দেবীর কাছে।

রমনা কালীমন্দিরেও দেখা গেল একই দৃশ্য। দেবীর বহু ভক্ত আসছেন বিদায়ী প্রণাম আর সিঁদুর খেলায় অংশ নিতে। মিটফোর্ড থেকে এসেছিলেন রীতা দত্ত ও ভ্রাতৃবধূ শ্রাবন্তী দত্ত। তাঁরা বললেন, এবার পূজায় অনেক আনন্দ হয়েছে।

ঢাকেশ্বরী মন্দিরে আজ সকাল থেকেই ছিল উপচে পড়া ভিড়। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে দেখা গেলে নারীদের প্রবেশের জন্য আর্চওয়ের (নিরাপত্তা ফটক) সামনে দীর্ঘ সারি। মণ্ডপের সামনে শত শত নারী তাঁদের সন্তানদের নিয়ে দেবী প্রণামের জন্য সমবেত হয়েছে। সিঁদুরদান শেষে অনেকেই সামনের খোলা চত্বরে এসে গানের তালে তালে মেতে উঠেছেন নৃত্যে। এখানে দেখা হলো বাংলাদেশ পূজা উদ্‌যাপন পরিষদের উপদেষ্টা ও সাবেক সভাপতি কাজল দেবনাথের সঙ্গে। তিনি বললেন, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর এবার একটি ভিন্ন পরিবেশে পূজা উদ্‌যাপিত হলো। এই জাতীয় মন্দিরে অন্তর্বর্তী সরকারে প্রধান উপদেষ্টা ড. মোহাম্মদ ইউনূসসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা এসেছেন। এমনকি যেসব রাজনৈতিক দল বরাবর শারদীয় দুর্গোৎসব থেকে দূরত্বের থেকেছে, এবারে তারাও সম্প্রীতির আহ্বান নিয়ে এখানে এসেছে। শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। এটা একটা বড় গুণগত পরিবর্তন। যথেষ্ট নিরাপত্তা ছিল। তিনি বলেন, ‘শুধু পূজার ৫ দিন নয়, আমরা চাই ৩৬৫ দিন যেন সংখ্যালঘুসহ দেশের সব মানুষ নিরাপদে বসবাস করতে পারেন।’

এখানে স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে এসেছিলেন তাঁতীবাজারের জনি দাস। তিনি একটি বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা। বললেন, প্রতিদিনই সপরিবারে প্রতিমা দর্শন করেছেন রাজধানীর বিভিন্ন মণ্ডপে ঘুরে ঘুরে।

ঢাকেশ্বরী মন্দিরে মহানগর পূজা উদ্‌যাপন পরিষদের সাবেক সভাপতি মণীন্দ্র কুমার নাথ বললেন, এবার ঢাকায় ২৫২টি মণ্ডপে পূজা হয়েছে, গত বছর হয়েছিল ২৪৮টি। তবে বন্যা ও কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার কারণে সারা দেশে পূজার সংখ্যা কিছু কমেছে। গত বছর ৩২ হাজার ৪০৮টি পূজা হয়েছিল এবার হয়েছে ৩১ হাজার ৪৬১টি। এবার নিরাপত্তা ভালো ছিল। তিনি বলেন, ‘আমরা চাই দেশে এমন একটা পরিবেশ সৃষ্টি হোক যেন সব ধর্মের মানুষ কোনো বিশেষ নিরাপত্তাবেষ্টনী ছাড়াই তাদের নিজ নিজ ধর্মের আচার অনুষ্ঠান উৎসব করতে পারবে। বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে দেশে একটি নতুন পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে, এখন একটি নিরাপদ মুক্ত পরিবেশ সবারই কাম্য।’

পূজা উদ্‌যাপন পরিষদের নেতারা জানালেন, বেলা দুইটা পর্যন্ত সিঁদুর খেলা ও মিষ্টিদান পর্ব চলবে। এরপর বিসর্জনের জন্য বিভিন্ন মণ্ডপ থেকে প্রতিমা নামিয়ে পলাশী রোডে আনা হবে। এরপর বিকেলে একসঙ্গে একটি বড় শোভাযাত্রা বুড়িগঙ্গায় প্রতিমা বিসর্জনের মাধ্যমে এ বছরের শারদীয় দুর্গাপূজার সব আয়োজন সম্পন্ন হবে।