February 25, 2025

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Tuesday, February 25th, 2025, 4:06 pm

বাসায় আগুন দেওয়ার পর ওরা গ্রেনেড ছুড়ে মারে

অনলাইন ডেস্ক:
‘আগুন ধরায়ে দিলে, ম্যাডামসহ সব পুড়ে মরবে। দে আগুন ধরায়ে দে। একযোগে দরজায় লাথি মারার শব্দ। একপর্যায়ে দোতালা বাড়ির নিচতলা ড্রইং রুমে ঢুকে ভেতরের সিঁড়ি দিয়ে চলে যায় দোতালায়। সেখানে বেডরুমে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। এরপর তারা চার-পাঁচটি গ্রেনেডের বিস্ফোরণ ঘটায়। এর আগেই ও লেভেল পাশ করা ছেলে নাদীদ হক বাড়ির ভেতর থেকে দরজায় লাথি মারার শব্দ শুনতে পেয়ে সোজা রান্নাঘরে কুকের রুমে চলে যায়। সেখানে খাটের নিচে নাদীদ, কুক হযরত আলী ও ওয়েটারসহ তিন জন লুকিয়ে পড়েন। বিডিআর সৈনিকদের মুখ লাল কাপড় দিয়ে ঢাকা। অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতে থাকে। একজনকেও বাঁচায় রাখা যাবে না। সবাইরে মারতে হবে। বাসায় আগুন লাগিয়ে বের হয়ে যাওয়ার পর বাড়ি লক্ষ্য করে প্রায় ১০-১৫ মিনিট ধরে গুলি করতে থাকে। আগুনের লেলিহান শিখা বাড়তে থাকলে তারা তিন জন প্রাণ বাঁচাতে বের হন। একপর্যায়ে নাদীদ সেখান থেকে ঝাঁপ দিয়ে পাশের ড্রেনে আত্মগোপন করে।’

পিলখানায় ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারির নির্মম হত্যাযজ্ঞের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে এসব কথা বলেন শহিদ কর্নেল মো. মুজিবুল হকের স্ত্রী নেহরীন ফেরদৌসী। সাক্ষাৎকারে কীভাবে তাকে ২০ ঘণ্টা একটি জিমে বন্দি করে রাখা হয়, সৈনিকরা তার কোয়ার্টারে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার পরও তার ছেলে কীভাবে বেঁচে গেল—সেসব বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরেন। কর্নেল মো. মুজিবুল হক ছিলেন তৎকালীন বিডিআরের ঢাকা সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার।

নেহরীন ফেরদৌসি বলেন, আমি কখনই জিমে যাই না। কিন্তু ঘটনার দিন ২৫ ফেব্রুয়ারি সকাল ৯টা বাজার ৫ মিনিট আগে মুজিবের সঙ্গে গাড়িতে বের হয়ে যাই। বড় ছেলে মুহীব হক প্রীতম থাইল্যান্ডে একটা ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনার জন্য ভর্তি হয়। মেজো ছেলে নদীদ হক ও লেভেল শেষ করে এ লেভেলে ভর্তির জন্য অপেক্ষা করছিল। সে বাসায় ছিল। ছোট মেয়ে তেহেরীম মুজিব বনানীর একটা স্কুলে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। সে স্কুলে গিয়েছিল। মুজিব আমাকে জিমে নামিয়ে দিয়ে যথারীতি দরবারে চলে যায়। ঐ দিন জিমে কেউ ছিল না। ঠিক সাড়ে ৯টার দিকে জিমের পিএ (বিডিআর সৈনিক) ফোন করে আমাকে বলে যে ম্যাডাম জিম থেকে বের হবেন না। সৈনিকরা বিদ্রোহ করেছে।

এ কথা শোনার পর আমি বাসায় আমার ওয়েটারের কাছে ফোন করে বাসার দরজা-জানালা বন্ধ করে নাদীদকে সাবধানে রাখার কথা বলি। এরপরই ডিজি ভাবীকে ফোন করে বলি যে সৈনিকরা বিদ্রোহ করেছে। ভাবী বাচ্চাদের নিয়ে সাবধানে থাকবেন। পৌনে ১০ টার দিকে মুজিবকে ফোন দেই। জিমে থাকার কথা শুনে বলে শিগগির বাসায় যাও। আমি সোয়া ১১ টার দিকে মুজিবের নম্বরে ফোন দিলে ওর রানার মিয়া আফতাব উদ্দিন ফোন রিসিভ করে বলে, ‘ম্যাডাম আপনি চিন্তা করবেন না। স্যারকে সেভ করে রাখছি। আপনি যেখানে আছেন, সেখানে থাকেন।’
একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নেহরীন ফেরদৌসী বলেন, আমি তো ভেবেছিলাম যে মুজিবকে ওরা সেভ করবে। কারণ ও সব সময় তার গাড়ি চালক ও রানারকে ভালোবাসতো। আমাকে সকালেই জিমে তালাবদ্ধ করে ওরা চলে যায়। সন্ধ্যার পর রাতের দিকে থেমে থেমে গুলি আওয়াজ পাই। আমি ঘুমাইনি। ভোর হয়। সকালের পর দুপুরের দিকে থেমে থেমে গুলির শব্দ শুনি।

তিনি বলেন, বিকাল ৫টার দিকে দুজন সৈনিক জিমের তালা খুলে দিল। আমাকে কোয়ার্টার গার্ডে নিয়ে যাওয়া হল। সেখানে অন্য ভাবিদের সঙ্গে দেখা হলো। তখন কয়েকজন সৈনিককে বললাম যে আমাকে বাসায় যেতে হবে। আমার ছেলে রয়েছে। তখন সৈনিকদের সঙ্গে নিয়ে আমি আমার বাসায় গেলাম। দোতলা বাড়িটি আগুনে পুড়ে গেছে। বাসার ভেতরে ঢুকে সব জিনিসপত্র পোড়া দেখলাম। ছেলের সন্ধানে বাড়ির ছাদে গেলাম। ছাদ থেকে তাকিয়ে দেখি নিচে আমার ছেলে হাউমাউ করে কাঁদছে। নিচে নেমে ছেলেকে জড়িয়ে ধরলাম। আমার সাজানো সংসার জ্বলে পুড়ে সব শেষ। আমার বাড়ির কাজের মেয়ে মিনাকে পেলাম না। দুই দিন পর জানতে পারি যে মিনা বাথরুমে আত্মগোপন করেছিল। সেখানে বিডিআর সৈনিকরা গ্রেনেড ছুড়ছিল। তাতে মিনা আহত হওয়ার পর মিনাকে বিডিআর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। মুজিবের স্মৃতি আঁকড়ে ধরে এখন বেঁচে আছি।