March 15, 2025

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Saturday, March 8th, 2025, 11:30 am

উপকূলের নারীদের টিকে থাকার সংগ্রাম, জলবায়ু পরিবর্তন ঝুঁকিতে উপকূলের নারীদের  প্রজনন স্বাস্থ্য

মাসুম বিল্লাহ ইমরান, খুলনা: জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে প্রজনন স্বাস্থ্য সহ  হুমকির  মুখে পড়েছে সুন্দরবন উপকূলীয় অঞ্চল কয়রার  মানুষের জীবনযাত্রা। নিয়ম করে বছরের বিভিন্ন সময় নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে নদ-নদীর বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে প্লাবিত হচ্ছে বিস্তীর্ণ এলাকা। বিশেষ করে  উপকূলীয় অঞ্চলের নারীর স্বাস্থ্য ও জীবন-জীবিকা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে। সেই সাথে নারীর প্রজনন স্বাস্থ্য মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে।

এক্ষেত্রে টেকসই উন্নয়নে জেন্ডার সমতার প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে উপকূলের নারীদের সমতা দুরের কথা, এখনো স্বাস্থ্য অধিকার নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। বরং জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকির কারণে নারী স্বাস্থ্যর ওপর বিরুপ প্রভাব পড়ছে।

গত কয়েক দশকে উপকূলীয় এলাকায় পানির লবণাক্ততা বৃদ্ধি পেয়েই চলেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারনে  পরিবেশের বিপন্নতার প্রভাব প্রথম এসে পড়ে নারীর ওপর। পানির স্তর নিচে নেমে যায়, নদীর পানি লবণাক্ত হয়ে যায়, নদী শুকিয়ে যায়, দুই-একটি নলকূপে, যেখানে মিষ্টি পানি ওঠে সেখানেও পানির জন্য হাহাকার। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করা না হলে কলসি নিয়ে পানির খোঁজে দীর্ঘপথ হাঁটতে হয় এসব নারীদের । আবার রান্নার জন্য জ্বালানি সংগ্রহ করতে নারীদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বনের ভেতরে যেতে হয় কাঠ কুড়াতে ।

উপকূলের নারীদের শুধু খাওয়ার পানিই নয়, সংসারে সবকিছুর জন্য যে পানি প্রয়োজন  সেই পানি সংগ্রহ করার দায়িত্বও নারীর। তাই সেই বিপর্যয় মোকাবিলায় নারীকে সামনে দাঁড়াতে হয়। উপকূলীয় অঞ্চল খুলনার কয়রা  উপজেলার নারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, লবণাক্ত পানি ব্যবহারের ফলে চুল ও ত্বকের ক্ষতি হয়।  এছাড়া গর্ভপাত ও অন্যান্য শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়। সেখানকার নারী ও শিশুরা চিংড়িপোনা ধরার জন্য নদীর লবণাক্ত  পানিতে  প্রায় ৪-৫ ঘণ্টা তাদের থাকতে হয়। এর ফলে প্রজনন স্বাস্থ্যসহ অন্যান্য স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়েন এসব নারী ও শিশুরা  । জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাড়তি তাপমাত্রা, বন্যা এবং প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ফলে গর্ভবতী নারীরা নানা স্বাস্থ্য সমস্যা যেমন উচ্চ রক্তচাপ, ডেলিভারি সম্পর্কিত জটিলতা, অকাল প্রসব এবং বাচ্চার জন্মগত সমস্যা মোকাবেলা করছেন।

লবণাক্ত পানির কারণে নারীরা এখন জরায়ু ক্যান্সারের মতো জটিল রোগে ভুগছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, দেশে প্রতিবছর যে কয়েক লাখ নারী জরায়ু ক্যান্সারের ঝুঁকিতে থাকে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশ উপকূলীয় অঞ্চলের নারী। নারীদের জরায়ুসংক্রান্ত অসুখের তীব্রতা লবণাক্ততা প্রবণ গ্রামগুলোতে বেশি দেখা যায় । সে জন্য অল্প বয়সেই এ এলাকার নারীরা জরায়ু কেটে ফেলতে বাধ্য হচ্ছে। উপকূলীয় উপজেলা কয়রার  প্রতিটি ইউনিয়নে জরায়ুসংক্রান্ত রোগে ভুগছেন এমন নারীর সন্ধান অনেক  পাওয়া যাবে ।

লবণাক্ততার প্রভাবে  শীর্ষক একটি গবেষণায় বলা হয়, উপকূলীয় অঞ্চলে নারী ও কিশোরীরা মাসিকের  সময় ব্যবহৃত কাপড় ধুয়ে আবারো সেটি ব্যবহার করে এবং লবণাক্ত পানিতে গোসলসহ দৈনন্দিন কাজের কারণে তাদের জরায়ুসংক্রান্ত রোগের উপস্থিতি অনেক বেশি। উপকূলের প্রায় প্রতিটি গ্রামেই জরায়ুসংক্রান্ত রোগে নারীরা আক্রান্ত, ডাক্তাররা রোগীদের জরায়ু কেটে ফেলার পরামর্শ দিচ্ছেন। নারীদের পুরো জরায়ু কেটে ফেলার পর অনেকের স্বামী তাদের ফেলে অন্যত্র বিয়ে করছেন।

শাকবাড়িয়া নদীর পাশে বসবাসকারী   স্বামী পরিত্যাক্তা বনজীবি নারী রেহানা খাতুন   বলেন,  উপকূলে জিবিকা নির্বাহের জন্য ৫০ শতাংশ নারীকে নদীতে মাছ ধরা সহ মৎস ঘেরে কাজ করতে হয়র।আমার  স্বামী  আমাকে চেড়ে যাবার  পর থেকে আমি নদীতে জাল টেনে  ও মৎস ঘেরে কাজ করে দুই মেয়েকে নিয়ে কোন রকম  সংসার চালাই। লবন পানিতে নামলে  শরীরের বিভিন্ন স্থানে এলার্জি এবং ঘা-পাঁচড়া, প্রস্রাবে জ্বালাপোড়াসহ পানি বাহিত রোগে আক্রান্ত  হতে হয় । অকাল গর্ভপাতের ঘটনা ও ঘটছে। বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়। আমাদের অঞ্চলে জরায়ু কেটে ফেলার ঘটনা ঘটছে অহরহ রয়েছে।

নারীর প্রজনন স্বাস্থ্য নিয়ে দীর্ঘ দিন কাজ করছে উপকূলের একটি সামাজিক  সংগঠন ‘ইনিশিয়েটিভ ফর কোষ্টাল ডেভেলপমেন্ট (আইসিডি) ’। সংগঠনটির   প্রতিষ্ঠতা আশিকুজ্জামান (আশিক) বলেন,  আমরা উপকূলের নারীদের জন্য বিভিন্ন প্রগ্রাম করি নারীকে পরিবেশগত ঝুঁকি মোকাবিলায় যত বেশি সংযুক্ত করা যাবে, আমরা তত বেশি লাভবান হবো। কারণ নারীরা ব্যক্তিগত ঝুঁকি ও নাজুকতার মধ্যেও দুর্যোগকালীন তার দায়িত্বগুলো সঠিকভাবে পালন করে যান। তাই টেকসই উন্নয়নের স্বার্থে নারীর প্রজনন স্বাস্থ্য অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। এ বিষয়ে উপকূলের নারীদের জন্য বিশেষ কর্মসূচী নিতে হবে।

কয়রার উত্তর বেদকাশি ইউনিয়নের বতুল বাজার কমিউনিটি ক্লিনিকের সিএইচসিপি উম্মেহানী আক্তার বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে উপকুলীয় অঞ্চলের নারীর মধ্যে দেখা দেয় পুষ্টিহীনতা। প্রায় সময় নারীর মধ্যে অনিয়মিত ঋতুস্রাব, জরায়ুতে সিস্ট, অসময়ে মেনোপোজসহ প্রজনন স্বাস্থ্যের নানা জটিলতা। কমিউনিটি পর্যায়ে স্বাস্থ্যকর্মীর সংখ্যা বাড়ানো এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রজনন স্বাস্থ্যবিষয়ক বিভিন্ন সচেতনতামূলক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নারী ও কিশোরীর মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো গেলে এ সমস্যা কমিয়ে আনা সম্ভব বলে তিনি মনে করেন।

কয়রা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ মোঃ রেজাউল করিম বলেন, লবনাক্ততার ফ‌লে চর্মরোগের পাশাপা‌শি ছত্রাকজনিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন এসব অঞ্চলের নারীরা। লবন পা‌নির সংষ্প‌র্ষে থাক‌লে নারী‌দের জরায়ু‌র সহ নানা পানি বাহিত রোগে আক্রান্ত হ‌ওয়ার ঝুঁ‌কি থাকে। আমরা সাধ‌্যমত সেবা দি‌য়ে যা‌চ্ছি। ত‌বে চিকিৎসক ও স্বাস্থ‌্যকর্মী সংকটের পাশাপা‌শি এ অঞ্চলের নারী‌দের স‌চেতনতার অভা‌বে কিছুটা জ‌টিলতা বাড়‌ছে।