April 25, 2025

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Monday, April 14th, 2025, 1:29 pm

খুলনা আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক ঘুস-কমিশন বাণিজ্যে গড়েছেন বিপুল সম্পদ

মাসুম বিল্লাহ ইমরান, খুলনা: দুর্নীতির টাকায় বিলাশবহুল জীবন যাপনের আরেক নজীর সৃষ্টি করেছেন খুলনা আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক ইকবাল বাহার চৌধুরী। ফ্যাসিস্ট সরকারের দোসর হিসাবে নিজের আখের গোছাতে মরিয়া ছিলেন তিনি। মালিক হয়েছেন বিপুল বিত্তবৈভবের। ইকবাল বাহারের বদলি ও কমিশন বাণিজ্যে দিশেহারা খুলনা খাদ্য বিভাগ। সরকারের উর্ধ্ব মহলের ছত্রছায়ায় ঘুষ ও উপঢৌকন বাণিজ্যে অপ্রতিরোধ্য ছিলেন তিনি। প্রধান উপদেষ্টার কাছে গত ০২/০৯/২০২৪ তারিখে দায়ের করা খুলনার খাদ্য পরিদর্শক সেলিম রেজার লিখিত অভিযোগে বেরিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য। অভিযোগের কপি পাঠানো হয় দুদক, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর, জেলা প্রশাসক, প্রেসক্লাব ও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন খুলনার সম্বয়কদের কাছে।

খোদ খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার যেখানে ছিলেন তার মাথার ওপর ছাতার মতো, মন্ত্রীর মেয়ের জামাই নাসের
বেগ যেখানে তার সব দুর্নীতির সহযোগী সেখানে তাকে ঠেকায় কে। নিশ্চিন্তে গড়ে তুলেছেন দুর্নীতির সাম্রাজ্য।
সরকারি অফিস সময় ৯-৫টা হলেও প্রতিদিন অফিস করেন সন্ধ্যার পর থেকে। দিনের বেলায় তাকে অফিসে পাওয়া
যায় না। সন্ধ্যার পরেই অফিসে বসে চালান নানা অপকর্ম ও ঘুষ বাণিজ্য। ইকবাল বাহারের হরিহর আত্মা সাবেক
খাদ্যমন্ত্রীর মেয়ের জামাই নাসের বেগ। রাজধানীর অভিজাত এলাকায় একই ভবনে রয়েছে তাদের দুজনের
আলীশান ফ্লাট। দুহাতে কামিয়েছেন অঢেল টাকা ।

খুলনার খাদ্যনিয়ন্ত্রকের দুনীর্তি ও অনিয়মের অনুসন্ধান শুরু হলে আঞ্চলিক কার্যালয়সহ খুলনার বিভিন্ন মহলে
তোলপাড় শুরু হয়। রীতিমতো গাত্রদাহ শুরু হয়েছে এ অসাধু কর্মকর্তার। ইতোমধ্যে বিভিন্ন স্থানে দৌঁড়ঝাপ শুরু
করেছেন আরসিফুড। সংবাদ প্রকাশ বন্ধের জন্য দেনদরবারও করেছেন। ওসিএলএসডিদের সাথে বৈঠক করে
আরসিফুড ঘটনাটি ধামাচাপা দিতে চালিয়েছেন নানামুখী তৎপরতা।

জানা গেছে, খুলনা আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক ইকবাল বাহার চৌধুরী খুলনা বিভাগের ১০টি জেলা থেকে ওএমএস
ডিলারের কাছ থেকে ও এম এস খাতে চাল ও আটা বিক্রিতে হিস্যা তুলছেন। কোন জেলায় কতটুকু চাল আটা
বরাদ্দ মাস শেষে ক্যালকুলেটর টিপে তার পার্সেন্ট বুঝে নেন। গুদামের ওসিএলএসডিরা ওই টাকা কালেকশন করে
আরসিফুডকে পৌঁছে দেন। কোনো জেলা হতে টাকা দিতে বিলম্ব করা হলে অফিসে ফোন করে ডেকে নিয়ে গুদাম
থেকে প্রত্যাহার করার হুমকি দেন। এতে সব সময় আতংকে থাকেন গুদামের ওসিএলএসডিরা। যে কারণে
সরকারের খাদ্যবান্ধব সময়সূচিও মুখথুবড়ে পড়ে। সরকারের গুরুত্বপূর্ণআরসিফুডের পদটি যেন অনৈতিক টাকা
আদায়ের ক্যাশিয়ারে পরিণত হয়েছে ।

সুত্র বলছে, আরসিফুড কোনো এলএসডি পরিদর্শনে গেলে ওসিএলএসডিদের কাছ থেকে ২০ হাজার টাকার খাম
নেন। ডাক্তারদের মতো এটা তার ভিজিট ফি। খাম না পেলে পরিদর্শনে খারাপ কিছু লিখে তাকে প্রত্যাহার করার
ভয় দেখান। অর্থাৎ ২০ হাজার দিলে পরিদর্শন রিপোর্ট ভালো, আর টাকা না দিলে পরিদর্শন রিপোর্ট খারাপ।
এছাড়া গাড়ির তেল বাবদ নেন ৮ হাজার টাকা। তার ড্রাইভার মিনহাজকে দিতে হবে ২ হাজার টাকা। না হলে
তিনিও খাম ধরেন না। কোনো কোনো পরিদর্শনে আবার ইকবাল বাহার চৌধুরী তার স্ত্রীকে নিয়ে যান। সে ক্ষেত্রে
দামী রিসোর্টে রাতযাপন, বারবিকিউ পার্টি ও শিল্পী এনে গান বাজনাসহ নানা মনোমুগ্ধকর আয়োজন করতে হয়।
সেই সাথে মোঘল সম্রাটের মতো খানাপিনা থাকতে হবে। ওসিএলএসডিকে নিয়ে তার স্ত্রীর জন্য শপিংয়ে যান।
ভিআইপি মার্কেটে গিয়ে ২০/৩০ হাজার টাকা দামের শাড়ি ও অন্যান্য সামগ্রী কেনেন ওসিএলএসডিদের টাকায়।
স্ত্রী ডাক্তার হওয়া সত্তে¡ও পেশা বেছে না নিয়ে স্বামীর সম্পদের পাহারাদারী করেন।

সম্প্রতি মাগুরায় পরিবারসহ পরিদর্শনে যান ইকবাল বাহার ঠৌধুরী। রাতে থাকার জন্য মাগুরা শহরের কোনো
আবাসিক হোটেল তার পছন্দ হয়নি। বেকায়দায় পড়ে যান মাগুরার ওসিএলএসডিরা। রাতে ঘুমানোর জন্য
আরসিফুডসহ তার পরিবারকে নিয়ে যাওয়া হয় নড়াইল জেলার চিত্রা রিসোর্টে। সেখানে মাগুরা সদর ওসিএলএসডি
তরুন বালার নেতৃত্বে রিসোর্ট বিলসহ তিন লাখ টাকার দামী উপহার সামগ্রী দিয়ে বিদায় দেয়া হয়।

সুত্র জানায়, গত মাসে মহেশ্বর পাশা সিএসডির মধ্যে ইকবাল বাহার চৌধুরীর জন্মদিন পালন হয়। সেখানে খুলনা
বিভাগের সকল ওসিএলএসডিরা এসে ৪টি খাশি জবাই করে জন্মদিন উদযাপন করেন। জন্মদিনের অনুষ্ঠান
উপলক্ষে জোরপূর্বক ওসিএলএসডিদের কাছ থেকে উপহার সামগ্রী নেন আরসিফুড। ইকবাল বাহার চৌধুরী আগে
থেকেই ওসিএলএসডিদের কাছে ডায়মন্ডের রিং দাবি করেন। ওসিএলএসডিরা তার জন্য ১ লাখ ৮৬ হাজার টাকা
দিয়ে ডায়মন্ডের রিং কিনে দেন। এছাড়া তাকে স্বর্ণের আংটি, ২৮০০০ টাকা দামের একটি রোলেক্স (বিদেশি ব্রান্ড)
ঘড়ি, বেøজারসহ বিভিন্ন মূল্যবান উপহার সামগ্রী দেয়া হয়।

জানা গেছে, কিছুদিন আগে শেখ হাসিনার নাম সম্বলিত বস্তাসহ চাল বিলিবিতরণ করায় যশোরের শার্শা এলাকায়
ব্যাপক বিপ্লব শুরু হয়। তখন যশোর জেলা প্রশাসক নাভারণ গুদাম কর্মকর্তাকে প্রত্যাহার করার জন্য আরসিফুড
ইকবাল বাহার চৌধুরীকে ফোন করেন। এরপর নাভারণ খাদ্য গুদামের ওসিএলএসডিকে আরসিফুড ইকবাল বাহার
চৌধুরী খুলনায় ডেকে পাঠান। প্রত্যাহারের ভয় দেখিয়ে আরসিফুড নাভারণ খাদ্য গুদামের ওসিএলএসডির কাছ
থেকে নগদ আট লাখ টাকা নিয়েছেন বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে। ওই সময় নাভারণ খাদ্য গুদামের
ওসিএলএসডিকে বোরো সংগ্রহ পর্যন্ত রাখার নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে।

ওসিএলএসডিদের বদলীর ক্ষেত্রে লাগামহীন অর্থ বাণিজ্যের কারণে খাদ্য গুদাম গুলোতে প্রতিনিয়ত নানা অনৈতিক
কর্মকান্ড চলছে। বদলির টাকা ম্যানেজ করতে গুদাম প্রত্যাশীরা জমি ও গহণা বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। ওই টাকা
তুলতে অনৈতিকতার আশ্রয় নিতে বাধ্য হচ্ছেন ওসিএলএসডিরা। শুধু তাই নয়, গুদাম থেকে অন্যত্র চাল সরানো,
অন্য স্থাপনা থেকে চাল আনা, গম আনা, এ ধরনের মুভমেন্ট এর জন্যও ইকবাল বাহার চৌধুরী টাকা ছাড়া কোনো
মুভমেন্ট এর চিঠি দেন না। চাল, গমের চাহিদা আরসিফুড অফিসে পাঠালেই ইকবাল বাহার চৌধুরী ৫০ হাজার
টাকা নেন। আরসিফুড অফিসের বড় বাবু শাহিনকে দিতে হয় ১০ হাজার টাকা। এ হেন দুর্নীতিতে নাভিশ্বাস
উঠেছে গুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের। আরসিফুডের লাগামহীন ঘুষ বাণিজ্যের কারণে ওসিএলএসডি’রা নানা
অনিয়মে জড়িয়ে পড়েছেন। প্রতিমাসে ঢাকায় মিটিং বাবদ আরসিফুড ওসিএলএসডিদের কাছ থেকে দেড় লাখ টাকা চাঁদা আদায় করছেন। খুলনা মিটিংয়ের খরচ নেয়া হয় ১ লাখ ২০ হাজার টাকা।

সুত্র বলছে, অবৈধ উপায়ে আরসিফুড ইকবাল বাহার চৌধুরী কোটি কোটি টাকা উপার্জন করেছেন। খুলনা
বিভাগের ওসিএলএসডিদের থেকে কালেশনকৃত টাকা তার অফিসে বড় বাবু শাহীনের মাধ্যমে তার নিকটস্থ বিশ্বস্ত
লোকের ব্যাংক একাউন্টে জমা দেয়া হয়। ব্যাংক ছাড়াও এসএ পরিবহণ, সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিসসহ বিভিন্ন
মাধ্যমে ওই টাকা পাঠান শাহীন। শাহীনকে জিজ্ঞাসাবাদ করলেই তার অবৈধ উপার্জনের হদিস বেরিয়ে আসবে বলে
নির্ভরযোগ্য সুত্র নিশ্চিত করেছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে আরসিফুড ইকবাল বাহার চৌধুরী ঢাকার ধানমন্ডিতে রয়েছে বিলাসবহুল ফ্ল্যাট। আরবান
ডিজাইন এবং ডেভেলপ লি. এর রোড ১১/সি, হাউজ নম্বর-৭৬ এর ৮/ সি নম্বর ফ্লাটটি তার ও তার স্ত্রী লামিউন
নাহার রুমকির নামে। যেটি ৩ কোটি আশি লাখ টাকায় কেনা। ঢাকার বসিলা এবং মুন্সীগঞ্ছে করেছেন বহু
জমাজমি। স্ত্রী সাথে ব্যাংকে জয়েন্ট অ্যাকাউন্টে আছে পাঁচ কোটি টাকা। ঢাকার বিভিন্ন আবাসিকে প্লট ও কুমিল্লাতে
নামে বেনামে রয়েছে কোটি কোটি টাকার সম্পদ ।

ইকবাল বাহার চৌধুরী নিজেও মোটা অংকের ঘুস দিয়ে বাগিয়ে নিয়েছেন পদপদবি ও প্রমোশন। খাদ্য বিভাগের
জুনিয়র অফিসার থাকার পরও সাবেক মন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারের জামাতা মাগুড়ার সাবেক ডিসি নাসের বেগকে
ঘুষ দিয়ে বরিশাল আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক হিসেবে পদায়ন নেন। এরপর এক কোটি টাকা ঘুস দিয়ে দুই সিনিয়রকে
ডিঙিয়ে খুলনা আঞ্চলিক কার্যালয়ের নিয়ন্ত্রক হিসেবে পদোন্নতি পান। ৫ আগস্টের পর মন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারের
বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হলেও ইকবাল বাহার রয়ে গেছেন ধরা ছোয়ার বাইরে ।

ইকবাল বাহার চৌধুরী পাবনা ডিসি ফুড থাকাকালীন দুর্নীতির কারণে মেয়াদ শেষ হওয়ায় আগেই তাকে প্রত্যাহার
করা হয়। তিনি জয়পুরহাটে ডিসি ফুড থাকাকালীন প্রশাসনিক কারণে সেখানে থেকেও তাকে প্রত্যাহার করা হয়।
ময়মনসিংহ জেলার ডিসিফুড থাকাকালীন মুক্তাগাছা ওসি এল এসডি’র সাথে মিলে ইকবাল বাহার ঠৌধুরী ৩ শ’ টন
চাল আত্মসাত করেন। বিষয়টি জানাজানি হলে দুনীর্তি দমন কমিশন অভিযান চালায়। ওই সময় তার নামে মামলা
দায়ের করে দুর্নীতি দমন কমিশন। সে মামলা এখনো চলমান রয়েছে।

অভিযোগের ব্যাপারে জানতে খুলনা বিভাগের আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক (আরসিফুড) ইকবাল বাহার ঠৌধুরীর
মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। পরে সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে মোবাইলে ক্ষুদে
বার্তা পাঠালেও কোনো সাড়া মেলেনি ।