মোঃ মোজাহেদুল ইসলাম
বাংলাদেশে স্মার্টফোন, ল্যাপটপ বা কম্পিউটারসহ প্রায় সব ধরনের প্রযুক্তিপণ্যের দাম পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর তুলনায় অনেক বেশি। এই মূল্যবৈষম্যের পেছনে নানা কারণ রয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
ব্যবসায়ীদের অতিমুনাফার অভিযোগ
অনেক ক্রেতার দাবি, দেশের কিছু ব্যবসায়ী অতিমুনাফার উদ্দেশ্যে ইচ্ছামতো পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, একটি ল্যাপটপ বাংলাদেশে যেখানে ৯৪ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে, সেটি পার্শ্ববর্তী দেশে বিক্রি হচ্ছে ৬৭ হাজার টাকায়। একই পণ্য যদি অনুমোদিত নয় এমন পরিবেশকের মাধ্যমে আমদানি হয়, তাহলে দাম পড়ে ৭৫ হাজার টাকা। অথচ অনুমোদিত পরিবেশকের কাছে দাম বেশি হওয়ার কারণ জানতে চাইলে তারা শুল্ক ফাঁকি দেওয়া আমদানিকারকদের দায়ী করেন।
শুল্ক ও করের ভার
দেশীয় উৎপাদক ও আমদানিকারক উভয় পক্ষই বলছেন, পণ্যের দামে বড় প্রভাব ফেলছে উচ্চ হারে শুল্ক ও কর। একজন আমদানিকারকের ভাষায়, একটি স্মার্টফোন আমদানিতে প্রায় ৫৯ শতাংশ পর্যন্ত কর দিতে হয়। এতে দেশীয় কোম্পানিগুলোও তুলনামূলক বেশি দামে পণ্য বিক্রি করার সুযোগ পায়।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্র জানায়, একটি স্মার্টফোন আমদানিতে ২৫% আমদানি শুল্ক, ১৫% ভ্যাট, ৫% অগ্রিম আয়কর, ৩% নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক এবং ৫% অগ্রিম করসহ মোট ৫৯% করভার পড়ে।
আন-অফিশিয়াল বনাম অফিসিয়াল পণ্য
রাজধানীর বিপণিবিতানগুলোয় দেখা যাচ্ছে, অফিসিয়াল ব্র্যান্ড স্টোরে যেই ফোন বা ল্যাপটপ বিক্রি হয় নির্ধারিত দামে, তা আশপাশের দোকানে পাওয়া যাচ্ছে অনেক কম দামে। এদের বলা হয় ‘আন-অফিশিয়াল’ বা গ্রে মার্কেটের পণ্য। উদাহরণস্বরূপ, একটি জনপ্রিয় ব্র্যান্ডের ফোন অফিসিয়ালভাবে ৫৭ হাজার টাকায় বিক্রি হলেও, একই ফোন আন-অফিশিয়ালি বিক্রি হচ্ছে মাত্র ৩২ হাজার টাকায়। ব্যবসায়ীদের দাবি, এইসব ফোন ‘লাগেজ পার্টি’র মাধ্যমে কর ফাঁকি দিয়ে আনা হয়।
গ্রে মার্কেটের বিস্তার
বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, বর্তমানে দেশের স্মার্টফোন বাজারের প্রায় ৪০ শতাংশই গ্রে মার্কেটের দখলে। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে বৈধভাবে আমদানিকৃত স্মার্টফোনের সংখ্যা মাত্র ৮৫০টি।
ক্রেতাদের দ্বিধা ও বিকল্প পথ
রবিউল নামে এক ক্রেতা জানান, তিনি ব্র্যান্ডের শোরুম থেকে ফোনটি দেখে নিলেও শেষ পর্যন্ত কম দাম দেখে পাশের দোকান থেকেই ‘আন-অফিশিয়াল’ ফোন কিনেছেন। তার মতে, যখন একই তলায় দুই দোকানে এত পার্থক্য থাকে, তখন অনেকেই কম দামেই ঝুঁকে যান।
কম্পিউটার মার্কেটেও একই চিত্র দেখা যায়। অনুমোদিত পরিবেশকদের তুলনায় অন্য দোকানে ল্যাপটপের দাম ১০-১২ হাজার টাকা পর্যন্ত কম। যদিও এই নিয়ে কিছু দোকানদার মামলার সম্মুখীনও হয়েছেন।
সরকারের ভূমিকা ও ভবিষ্যৎ করনীতি
একটি মোবাইল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের প্রধান জানান, দেশে স্মার্টফোন তৈরি করে পরিবেশক পর্যন্ত পৌঁছাতে ১৮-২০ শতাংশ কর দিতে হয়, এবং খুচরা পর্যায়ে সেটি আরও বাড়ে। ভারতে যেখানে স্মার্টফোনে কর ১৮ শতাংশ, পাকিস্তানে তা ২৫ শতাংশ, সেখানে বাংলাদেশে তা অনেক বেশি। রেজওয়ানুল হক নামে এক উদ্যোক্তা বলেন, কর কমালে দাম কমবে এবং মানুষ বৈধভাবে ফোন কিনবে। সরকারকে স্মার্টফোন ব্যবহার বৃদ্ধির লক্ষ্যে করনীতি পর্যালোচনা করতে হবে।
ইন্টারনেট ব্যবহার ও স্মার্টফোনের প্রসার
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারের হার দাঁড়িয়েছে ৫২ শতাংশ, যা আগের তিন মাসে ছিল ৫০.৪ শতাংশ। শহরে এই হার ৬১.৬ শতাংশ, আর গ্রামে ৪৮.২ শতাংশ। এছাড়া দেশের ৯৮.৭ শতাংশ পরিবারে মোবাইল ফোন আছে, যার মধ্যে ৭২ শতাংশ পরিবারে রয়েছে একাধিক স্মার্টফোন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রযুক্তিপণ্যের মূল্যসাশ্রয়ী করার জন্য কর কাঠামোতে পরিবর্তন জরুরি। ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে সরকার যদি স্মার্টফোন ও প্রযুক্তিপণ্যে সহনীয় কর আরোপ করে, তাহলে ব্যবহার বাড়বে, অবৈধ আমদানি কমবে এবং সরকারের রাজস্বও বাড়বে।
আরও পড়ুন
সারাদেশে একই দামে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট
বৃষ্টিতে বাইক চালানোর পর যেসব কাজ করবেন
বন্ধ হলো একসময়ের জনপ্রিয় যোগাযোগমাধ্যম স্কাইপি