April 27, 2025

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Saturday, April 26th, 2025, 2:15 pm

হানি ট্র্যাপ: জিম্মি করে টাকা হাতানো, শেষ পর্যন্ত জীবনও বিপন্ন

 

মোঃ মোজাহেদুল ইসলাম

বর্তমানে ‘হানি ট্র্যাপ’ বা মধু ফাঁদ আতঙ্কের এক নতুন নাম হয়ে উঠেছে। দিনকে দিন হানি ট্র্যাপের মাধ্যমে মানুষকে মানি ট্র্যাপে ফেলে লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে চক্রগুলো। সুন্দরী তরুণীদের দিয়ে সাজানো এসব চক্রের প্রধান লক্ষ্য সমাজের প্রতিষ্ঠিত ও ধনী ব্যক্তিরা। এমনকি বিদেশি রাষ্ট্রদূতরাও এদের টার্গেট থেকে রেহাই পাচ্ছেন না। দেশ ও বিদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে অনলাইন এবং অফলাইনে সক্রিয় রয়েছে এই চক্রগুলো। নিখুঁত পরিকল্পনায় সুন্দরী তরুণীদের মাধ্যমে ফাঁদ পাতছে তারা। যৌন আকর্ষণের ফাঁদে ফেলে ধীরে ধীরে ভুক্তভোগীর জীবনকে ধ্বংস করে দিচ্ছে এবং দিনের পর দিন লাখ লাখ টাকা আদায় করছে।

একাধিক ভুক্তভোগীর ভাষ্য মতে, প্রথমে সুন্দরী তরুণীরা টার্গেট ব্যক্তির সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তোলে, পরে সম্পর্ক রূপ নেয় প্রেমে। শুরু হয় যৌনতা কেন্দ্রিক আলাপচারিতা। ভিডিও কলের মাধ্যমে খোলামেলা কথোপকথনের দৃশ্য গোপনে রেকর্ড করে পরে তা দিয়ে ব্ল্যাকমেইল করা হয়। কখনও আবার রুম ডেটের নামে ডেকে নিয়ে গোপন স্থানে আটকে জিম্মি করে মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করা হয়।

তথ্যসূত্র জানায়, ভিডিও কলে নগ্ন অবস্থায় কথা বলার সময় দৃশ্য ধারণ করে জিম্মি করা তরুণীদের অনেকেই বিদেশে অবস্থান করেন। তারা টার্গেট ব্যক্তির ফেসবুক বন্ধুদের, এমনকি স্ত্রী-সন্তানদেরও ফ্রেন্ডলিস্টে যুক্ত করে নেয়। এরপর দাবি করা টাকা না পেলে এসব ভিডিও ও ছবি ভাইরাল করার হুমকি দেয়। এভাবে আদায় করা টাকার একাংশ হুন্ডি বা ক্রিপ্টোকারেন্সির মাধ্যমে বিদেশে পাঠানো হয়। ভুক্তভোগীরা সামাজিক সম্মান হারানোর ভয়ে অধিকাংশ সময়ই আইনি সহায়তা নিতে চান না। আবার অনেক ক্ষেত্রে অভিযুক্তরা গ্রেফতার হলেও আইনের ফাঁক গলে মুক্তি পেয়ে যায়। অভিযোগ রয়েছে, কিছু প্রভাবশালী আইনজীবীরাও এই চক্রের ফাঁদে পড়ে জিম্মি হয়ে আছেন।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তাদের মতে, ২০ থেকে ৫০ বছর বয়সী পুরুষরাই সবচেয়ে বেশি এই ফাঁদে পা দিচ্ছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ছাড়াও ‘কলগার্ল’ সরবরাহের আড়ালেও হানি ট্র্যাপ চালানো হচ্ছে। সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টারে প্রতি মাসে গড়ে ৩০টির মতো এ সংক্রান্ত অভিযোগ জমা পড়ছে।

বেশিরভাগ ভুক্তভোগীই মামলা না করে সমস্যার সমাধান চান। তবে প্রযুক্তি ব্যবহারে সচেতনতা ছাড়া এ ধরনের প্রতারণা থেকে মুক্তির কোনো বিকল্প নেই বলে মনে করেন সাইবার অপরাধ বিশেষজ্ঞরা।

প্রযুক্তিবিদদের মতে, হানি ট্র্যাপ একটি ধূর্ত অপকৌশল। সাধারণত ধনী, গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, রাজনীতিক, ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন শ্রেণির মানুষকে ফাঁদে ফেলার জন্য এ পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। কেবল আইন প্রয়োগ করেই এটি বন্ধ করা সম্ভব নয়; প্রযুক্তি ব্যবহারে সচেতন হতে হবে।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সাইবার ইউনিট সূত্র জানায়, অধিকাংশ ভুক্তভোগী বর্তমান বা অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা। তাদের জিম্মি করে বিকাশ ও নগদ অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে টাকা আদায় করা হয়, যেখানে ব্যবহৃত ফোন নম্বরের নিবন্ধনও হয় ভুয়া পরিচয়ে। ফলে অপরাধীরা সহজেই আইনের হাত এড়িয়ে যায়। সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টারের তথ্য মতে, ফেসবুক, ইমো, টেলিগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ, ইনস্টাগ্রাম, টিকটক এবং ইউটিউব শর্ট ভিডিওর মাধ্যমে প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ এই ফাঁদে পড়ছেন। গুরুতর অভিযোগের সংখ্যা মাসে গড়ে ৩০টি।

সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টারের ডিআইজি মো. আবুল বাশার তালুকদার বলেন, “শুধু আইন প্রয়োগ করে এ অপরাধ বন্ধ করা যাবে না; মানুষের সচেতন হওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই।” তিনি আরও জানান, ভুক্তভোগীদের অধিকাংশই প্রযুক্তি সম্পর্কে অজ্ঞাত, যা চক্রগুলোর অপকৌশল সফল করছে।

ভুক্তভোগী সোহেল মৃধা, যিনি বর্তমানে সৌদি আরব প্রবাসী, গণমাধ্যমকে জানান, ইমোতে আঁখি আক্তার নামে এক তরুণীর সঙ্গে তার পরিচয় হয়। সম্পর্ক গভীর হওয়ার পর ভিডিও কলে নগ্ন হয়ে কথা বলার সময় তরুণী তা রেকর্ড করে এবং পরে ব্ল্যাকমেইল করে চার লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়। ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে আঁখি আক্তার পরিচয় শুনেই ফোন কেটে দেন এবং পরে আর ফোন ধরেননি।

বরিশালের আরেক ভুক্তভোগী অভিযোগ করেছেন, ফেসবুকের ‘লাভারস ওয়ার্ল্ড’ নামক একটি সাইট থেকে সঙ্গীতা নামে এক নারীর সঙ্গে পরিচয় হয়। পরে তার মাধ্যমে আরও কয়েকজন নারীর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং ব্যবসায়িক অংশীদারিত্বের প্রলোভনে এনআইডি কার্ড ও টাকা প্রদান করেন। পরে তাকে নগ্ন ছবি তৈরি করে ব্ল্যাকমেইল করা হয়।

রাজধানীর মিরপুরের এক ব্যবসায়ী জানান, ফেসবুকে নেপালি এক তরুণীর সঙ্গে বন্ধুত্বের সূত্রে ভিডিও কলে ঘনিষ্ঠ হওয়ার পর হঠাৎ তরুণী তার মায়ের অসুস্থতার অজুহাতে টাকা দাবি করে। টাকা না দিলে ঘনিষ্ঠ মুহূর্তের ছবি ফেসবুকে ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেয়।

ভুক্তভোগীরা জানান, তারা মূলত ফেসবুক, ইমো, টেলিগ্রাম, ইনস্টাগ্রাম, টিকটক, ইউটিউবের শর্ট ভিডিওর মাধ্যমে এসব ফাঁদে পা দিয়েছেন। অনলাইনে দেওয়া লোভনীয় বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে তাদের আকৃষ্ট করা হয়েছে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্য অনুযায়ী, এ ধরনের ভুক্তভোগীর সংখ্যা দিন দিন বাড়লেও তাদের ৯০ শতাংশই সামাজিক ও পারিবারিক সম্মানের ভয়েই আইনি পদক্ষেপ নিতে চান না। যারা অভিযোগ করছেন, তাদেরও বড় অংশ মামলা করতে রাজি হন না।

অপরাধ বিশ্লেষকরা মনে করেন, দেশের ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা দ্রুত বাড়লেও সাইবার নিরাপত্তা সচেতনতার অভাব রয়েছে। ফলে এ ধরনের প্রতারণা দিন দিন বাড়ছে।