July 13, 2025

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Saturday, July 12th, 2025, 6:07 pm

উন্নয়ন বিচ্যুতিতে রংপুর রেলওয়ে স্টেশন মাসে আয় কোটি টাকা, উন্নয়নে মন নেই

রংপুর ব্যুরো চীফ

উন্নয়ন বিচ্যুতিতে রংপুর রেলওয়ে স্টেশন মাসে আয় কোটি টাকা, উন্নয়নে মন নেই
আব্দুর রহমান মিন্টু,রংপুর : রংপুর স্টেশন প্রতিষ্ঠা লাভ করে ১৮৭৮ সালের ২ জুলাই। একটি মাত্র প্ল্যাটফর্ম, একটি মেইন লাইন, দুইটি লুপ লাইন ও ৩ টি ইয়ার্ড লাইন নিয়ে মোট ৬ টি লাইন। ১৯৪৪ সালে রংপুর স্টেশনে বড় সংস্কার করা হয়। এরপর বড় কোন সংস্কার দেখা যায়নি রংপুর স্টেশনে। ১৯৪৪ সালে সে-সময়ের আধুনিক রংপুর রেল স্টেশন প্রতিষ্ঠা করা হয়।
উন্নয়নের বলয় থেকে বিচ্যুত একটি রেল স্টেশনের নাম রংপুর রেলওয়ে ষ্টেশন। বিভাগীয় শহরের এই রেলস্টেশনটি দীর্ঘদিন থেকে পাচ্ছে না ঈদেও কোন বিশেষ ট্রেন। শুরু থেকে নেই কোন সংস্কার, মান্ধাতা কাঠামো, অনিরাপত্তা এই স্টেশনের পরতে পরতে দৃশ্যমান। প্রতি মাসে এই স্টেশন থেকে প্রায় কোটি টাকা আয় হলেও এর উন্নয়নে কর্তৃপক্ষের নেই কোন পরিকল্পনা।
জানা যায়, এবারের কোরবানী ঈদে ঘরমুখো মানুষের জন্য রংপুর বিভাগের পার্বতীপুর, পঞ্চগড় ও বুড়িমারিতে দেয়া হয়েছে বিশেষ ট্রেন। তবে কোন বিশেষ ট্রেন পায়নি রংপুর রেলওয়ে স্টেশন। রংপুর রেলওয়ে স্টেশনের তথ্যমতে ২০২৩ সালে ঈদের মৌসুমে এই স্টেশনটি থেকে সেবা নিয়েছিল ৫ লাখ ৯২ হাজার ৭০৪ জন যাত্রী, ২০২৪ সালে সেবা নেয় ৭ লাখ ৬৬ হাজার ৬৬২ জন যাত্রী। এছাড়াও চলতি মাসে গত সোমবার পর্যন্ত সেবা নেয় প্রায় ৮ লাখ যাত্রী।
রংপুর রেলওয়ে স্টেশনের তথ্যমতে, ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের মে মাস পর্যন্ত ১০ কোটি ১ লাখ ৩৯ হাজার ৭১২ টাকা আয় হয়, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ১১ কোটি ২৯ লাখ৬ হাজার ২৯৬ টাকা ও ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১১ কোটি ৪২ লাখ ১৭ হাজার ৯১২ টাকা আয় হয়। এই স্টেশন থেকে রেল কর্তৃপক্ষ ভাল আয় করলেও গ্রেড বৈষম্য রয়ে গেছে। ২০১৯-২০২০ সালে যাত্রীর সংখ্যা ৩ লক্ষ ১০ হাজার ৮২ জন। এবছর মোট আয় ৪ কোটি ৯৭ লক্ষ ৩৫ হাজার ৯২১ টাকা। পরের বছর যাত্রীর সংখ্যা আরো কমে। ২০২১-২০২২ সালে যাত্রীর সংখ্যা ছিল ১ লক্ষ ৭৯ হাজার ৬৫৬ জন। এবছর মোট আয় ৫ কোটি ৩৯ লক্ষ ৮৪ হাজার ৬৯৮ টাকা।
রেল স্টেশনের নানা সমস্যায় প্রতিনিয়ত ভুক্তভোগী সাধারণ যাত্রীরা। বিভাগীয় এই রেলস্টেশনে নেই পাবলিক টয়লেট। প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে মানুষ ছোটে আশেপাশের খোলা জায়গায়। নেই কোন মাতৃদুগ্ধ কর্ণার। ফলে শিশুসন্তান নিয়ে প্রায়শই নানামূখী সমস্যায় ভোগেন মায়েরা।  রেলস্টেশনটিতে এপার থেকে ওপারে চলাচলের জন্য ওভারব্রীজ সংকট রয়েছে।
জন্ম থেকেই রংপুর রেল স্টেশন বি-গ্রেডের রয়ে গেছে। এই স্টেশন দিয়ে সিঙ্গেল লাইনের ট্রেন চলাচল করে। রেল স্টেশেনের চারিদিকে নেই কোন বেস্টনী। পূর্ব-পশ্চিম ও দক্ষিণ তিন দিকেই খোলা। বলা চলে অরক্ষিত। তিনদিক খোলা থাকায় রাত হলে স্টেশনের আশেপাশে বিভিন্ন অপরাধ কর্মকান্ড, বিশেষ করে নেশাখোরদের আড্ডা বসে। এছাড়াও লোকবল সমস্যায় ধুকছে এই রেলস্টেশনটি। ফলে প্রাতিষ্ঠানিক নানা কাজেও বিলম্ব হচ্ছে বলে জানান এখানকার রেল সুপারিন্টেন্ডেন্ট শংকর গাঙ্গুলি।
প্রতিদিন এই রেল স্টেশন থেকে আন্তঃনগর রংপুর এক্সপ্রেস, কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেস, দোলন চাঁপা এক্সপ্রেস, লোকাল এলআর, কমিউটার ৬১,৬২, ৬৩, ৬৪, ৭১, ৭২ সহ ৬ জোড়া ট্রেন বিভিন্ন স্থানে যাতায়াত করে। রংপুর ও কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেস ঢাকায় যাতায়াত করে। এছাড়াও বন্ধ রয়েছে কুড়িগ্রামের চিলমারীগামী রমনা লোকাল ও সান্তাহার, পঞ্চগড়গামী সেভেন আপ এইট ডাউন মেইল। প্রতিদিন এই স্টেশন থেকে আড়াই থেকে তিন হাজার যাত্রী দেশের বিভিন্ন স্থানে চলাচল করেন।
জানা গেছে, রংপুর রেল স্টেশনের পশ্চিমে বন্দর শ্যামপুর এবং পূর্ব দিকে মীরবাগ বাজার স্টেশনটি বি-গ্রেডের। কাগজে কলমে শ্যামপুর ও মীরবাগের সাথে রংপুর স্টেশনের কোন পার্থক্য নেই। কাউনিয়া, লালমনিরহাট এ-গ্রেডের স্টেশন হলেও রংপুর রেলওয়ে স্টেশন পড়েনি এই গ্রেডে।
অনেকেই মনে করছেন রংপুর রেলওয়ে স্টেশনে ট্রেনের সংখ্যা বাড়ানো সহ ডুয়েলগেজ ও ব্রডগ্রেজ লাইন করা হলে যাতায়াতে যেমন সুবিধা বাড়বে, তেমনি এখান থেকে বাড়বে সরকারের আয়। এছাড়াও প্রতিবছর সড়কে যে চাপ পড়ে সেটাও কমে যাবে অনেকাংশে। গত এক বছরে ২০২৪ সাল থেকে ১৯৫ টি দুর্ঘটনায় রংপুর মহাসড়কেই মারা গেছে ১৪৬ জন। এর মধ্যে ১২০ পুরুষ, ২২ জন মহিলা, ৪ জন শিশু। এছাড়াও ১৯১ জন গুরুতর আহত হয়েছেন। এতে ২২৪ টি যানবাহনের ক্ষতি হয়। সড়ক দুর্ঘটনায় এ সংক্রান্ত ১৫২ টি মামলা হয়েছে।
রংপুর হাইওয়ে পুলিশ সুপার তারিকুল ইসলাম জানান, ‘জীবনের মূল্য কিছু দিয়েই পরিমাপ করা যায় না। তবে গত এক বছরে কমপক্ষে এই সড়কেই ১০০ কোটি টাকার মতো যানবাহনের ক্ষতি হয়েছে।’
অন্যদিকে রংপুরে প্রতিবছর রবিশস্য লক্ষ্যমাত্রার থেকে বেশি উৎপাদন হচ্ছে। ফলে অনেকসময় ক্ষেতেই নষ্ট হচ্ছে কৃষকের স্বপ্নের ফসল। রংপুর রেলওয়ে স্টেশনে ডুয়াল গেজ ও ব্রড লাইন সংযোজন করা হলে এখান থেকে সারাদেশে পৌঁছে যাবে রংপুরের ফসল। ফলে একদিকে যেমন শস্য বিনিময়ের মাধ্যমে ফসল বিক্রি করে কৃষকের আয় বাড়বে। অন্যদিকে অযাচিত মূল্য বৃদ্ধিও কমিয়ে আনা সম্ভব বলে মনে করছেন সংশ্লীষ্টরা।
রংপুর চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি আকবর আলী বলেন, ‘রাজশাহীতে আমের মৌসুমে আলাদা করে ট্রেন দেয়া হয়। রংপুরেও একটি ট্রেন দেয়া উচিৎ হাড়িভাঙা আম পরিবহনের জন্য। এছাড়াও রংপুর রবিশস্যের ভান্ডার। এখানে স্পেশাল ট্রেন থাকলে শস্য বিনিময়ের মাধ্যমে ফসলের যথাযথ ব্যবহার করে লাভবান হতে পারতো কৃষকেরা।’
রংপুর রেলওয়ে স্টেশন উন্নয়ন না হওয়ার পেছনে অনেকেই রংপুরের নেতৃত্বের অযোগ্যতা বলে মনে করছেন। , ‘বিগত ১৬ বছরে রংপুর উন্নয়নের পরিধির বাইরে ছিল, বর্তমানেও তাই হয়েছে। এখানে দেশের দুজন রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন। কিন্তু কারোই রংপুরের উন্নয়নে দরদ দেখা যায়নি। ফলে উন্নয়ন বিচ্যুতির মধ্যে বরাবরই পরে আছে। এখানে উন্নয়নের কথা বলার ও দাবি করে নিয়ে আসার লোকের খুব অভাব। বলতে গেলে যোগ্য নেতৃত্বের অভাব বরাবরই রয়ে গেছে।’
রেল স্টেশন সূত্রে জানা গেছে, ভারত উপমহাদেশে ১৮৫১ সালে প্রথম রেলওয়ে স্টেশন চালু করেন লর্ড ডালহৌসি। এরই প্রায় ২৬ বছর পর রংপুর জেলায় স্থাপিত হয় একটি রেলওয়ে স্টেশন। রংপুর স্টেশন প্রতিষ্ঠা লাভ করে ১৮৭৮ সালের ২ জুলাই। একটি মাত্র প্ল্যাটফর্ম, একটি মেইন লাইন, দুইটি লুপ লাইন ও ৩ টি ইয়ার্ড লাইন নিয়ে মোট ৬ টি লাইন। ১৯৪৪ সালে রংপুর স্টেশনে বড় সংস্কার করা হয়। এরপর বড় কোন সংস্কার দেখা যায়নি রংপুর স্টেশনে। ১৯৪৪ সালে সে-সময়ের আধুনিক রংপুর রেল স্টেশন প্রতিষ্ঠা করা হয়। দেখতে দেখতে বৃটিশ ও পাকিস্তান শাসনামল চলে গেছে। বাংলাদেশ স্বাধীনতার প্রায় ৫২ বছর হতে চলেছে। সরকার আসে, সরকার যায়। কিন্তু রংপুর রেল স্টেশনটিকে এ-গ্রেডে উন্নীত করার কোন পদক্ষেপ কেউ হাতে নেননি।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের রংপুর মহানগর আহবায়ক ইমতিয়াজ আহমেদ ইমতি বলেন, ‘আমরা রংপুর রেলওয়েস্টেশনকে জংশন বানানোর দাবি তুলেছি। তবে এবার ঈদে কেন যে বিশেষ ট্রেন দিলোনা সেটা আমার জানা নাই। ভবিষ্যতে যেন এরকম না হয় সেব্যাপারে আমরা সচেষ্ট থাকবো।’
রংপুর রেলস্টেশনের সুপার শঙ্কর গাঙ্গুলি বলেন, ‘পঞ্চগড়ে রেললাইনের কাজ একেবারেই কমপ্লিট হয়েছে। এবার রংপুরে ডুয়াল লাইন ও ব্রডগেজের কাজ শুরু হলেই রংপুর থেকে সারাদেশে মানুষ যাতায়াত করতে পারবে।