August 12, 2025

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Wednesday, August 6th, 2025, 4:13 pm

খুলনায় কোটা সংস্কার আন্দোলনে ঐতিহাসিক অধ্যায়

২০২৪ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলন যখন ঢাকার রাজপথে শুরু হয়, তখন খুলনা হয়ে ওঠে এক বিস্ফোরিত গণসচেতনতার প্রতিচ্ছবি। কেন্দ্রীয় নিপীড়ন, হাইকোর্টের বিতর্কিত রায় ও প্রশাসনিক দমনপীড়নের বিপরীতে খুলনার ছাত্র, শিক্ষক ও সাধারণ মানুষ গড়ে তোলে প্রতিরোধের ব্যতিক্রমী কাঠামো।

৬ জুন খুলনা প্রেসক্লাবের সামনে ‘খুলনা সচেতন ছাত্র সমাজ’-এর মানববন্ধন আন্দোলনের সূচনা ঘটায়, নেতৃত্ব দেন মহররম হোসেন মাহিম ও সাজিদুল ইসলাম বাপ্পি। শুরু থেকেই পাশে দাঁড়ায় খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ন্যাশনালিস্ট টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন, যার নেতৃত্বে ছিলেন খুবি বর্তমান ভিসি প্রফেসর ড. মো. রেজাউল করিম, ব্যবসা প্রশাসনের শরীফ মোহাম্মদ খান, ফরেস্ট্রি এন্ড টেকনোলজি ডিসিপ্লিনের প্রফেসর ড. মো. নাজমুস সাদাত এবং এই সংগঠনের বাইরে খুবির পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের ড. আব্দুল্লাহ হারুন চৌধুরী, ইংরেজি বিভাগের প্রফেসর মোহাম্মদ সামিউল হক।

সরকারি কলেজের শিক্ষকরাও আন্দোলনের পক্ষে দাঁড়ান। বিএল কলেজের প্রফেসর ড. আনিস আর রেজা, মহিলা কলেজের রবিউল ইসলাম, মহসিন কলেজের অধ্যক্ষ আব্দুস সালাম ও যশোর বোর্ডের এসএম তৌহিদুজ্জামান আন্দোলনকে একাডেমিক ও সামাজিক স্বীকৃতি দেন।

১৬ জুলাই রংপুরে ছাত্র শহীদ আবু সাঈদের মৃত্যুর খবরে খুলনা জেগে ওঠে। খুবি, কুয়েট, বিএল কলেজ, মহিলা পলিটেকনিক, পাবলিক কলেজ, জিলা স্কুলসহ প্রায় ২৫টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা শিববাড়ি মোড়ে বিক্ষোভে নামে।

১৬ জুলাই রংপুরে আবু সাঈদের শহীদ হওয়ার সংবাদে খুলনায় উত্তাল হয় জনতা। খুবি, কুয়েট, খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, নর্দার্ন ইউনিভার্সিটি, সরকারি বিএল কলেজ, নৌ-বাহিনী স্কুল এন্ড কলেজ, খান জাহান আলী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মহাবিদ্যালয়, খুলনা পাবলিক কলেজ, খুলনা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউ, খুলনা মহিলা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, সরকারি হাজী মুহাম্মাদ মহসিন কলেজ, খুলনা সরকারি মহিলা কলেজ, রোটারী স্কুল, সরকারি ইকবাল নগর উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়, সেন্ট জোসেফ স্কুল, সরকারি করোনেশন বালিকা বিদ্যালয়, সুলতানা হামিদ আলী বালিকা বিদ্যালয়, খুলনা কলেজিয়েট গার্লস স্কুল এন্ড কলেজ, শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, খুলনা জিলা স্কুল, দৌলতপুর কলেজ ও সরকারি সুন্দরবন আদর্শ কলেজের শিক্ষার্থীরা বিক্ষিপ্তভাবে শিববাড়ি মোড়ে জড়ো হতে থাকে। ১৯ জুলাই শিক্ষার্থীরা খুবিতে গায়েবানা জানাযার আয়োজন করলে পুলিশ বাঁধা দেয়।

৩০ জুলাই জেলা প্রশাসনের ডাকা বৈঠকে কেসিসির তৎকালীন মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেক ও খুলনা-৩ আসনের সাবেক এমপি মো. কামাল হোসেন প্রতিষ্ঠান প্রধানদের আন্দোলন দমন করার নির্দেশ দেন। ৩১ জুলাই রাতে সার্কিট হাউজে ছাত্রদের ডেকে জোর করে আন্দোলন থেকে সরে দাড়ানো ও বন্ধের বিবৃতি দিতে বাধ্য করে, যা রাতেই খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রত্যাখ্যান করে।

এই অবস্থান আরও পোক্ত হয় যখন খুবির ড. আব্দুল্লাহ হারুন ঢাকায় গড়ে তোলেন শিক্ষক নেটওয়ার্ক, জাহাঙ্গীরনগরের আনু মোহাম্মাদ ও ঢাবির গীতিয়ারা নাসরিন এতে যুক্ত হন। জুলাইয়ের শেষদিকে নগরীর শিববাড়ি মোড়ে ‘স্টেপ ডাউন শেখ হাসিনা’ লেখা গ্যাস বেলুন উড়ে, আর আকাশ-বাতাস মুখরিত হয় ‘মেধা না কোটা, মেধা মেধা’, ‘বুক পেতেছি গুলি কর’, ‘সারা বাংলায় খবর দে, কোটা প্রথার কবর দে’এই ধরনের স্লোগানে।

২ আগস্ট জুমার নামাজের পর জিরোপয়েন্টে জড়ো হওয়া মিছিলে পুলিশ রাবার বুলেট ও ছররা গুলি চালায় পুলিশ। সন্ধ্যায় গল্লামারিতে পুলিশের সঙ্গে জনতার সংঘর্ষে পুলিশ সদস্য সুমন ঘরামী নিহত হন। পরদিন কুয়েট ও খুবির শিক্ষকরা আন্দোলনের পক্ষে মানববন্ধন করে। অন্যদিকে নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠনগুলো শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে মিছিল করলেও, ‘খুলনা সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক)’ শিক্ষার্থীদের পক্ষে মানববন্ধনে দাঁড়ায়।

খুলনার আন্দোলনে শীর্ষনেতৃত্বে ছিলেন, সরকারি সুন্দরবন আদর্শ কলেজের শহীদুল আলম জিহাদ, জিলা স্কুলের আল নাহিয়ান চারু, খুলনা সরকারি মহিলা কলেজের জান্নাতুল ফেরদৌস শান্তা, সবনব ইসলাম মারিয়া, সাবরিন খান মাঈশা, খুলনা মহিলা পলিটেকনিকের লিজা খাতুন, বিএল বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের সাজিদুল ইসলাম বাপ্পি, হরযত আলী, ইয়ামিন গাজী, মো. তানভির খন্দকার, সাকিল আহম্মেদ, সিহাব আরাফ, রুমি রহমান, সরকারি খুলনা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের সাবেক শিক্ষার্থী লামিয়া আক্তার লাম, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের মিনহাজুল আবেদীন সম্পদ, জহিরুল ইসলাম তানভির, মুহিবুল্লাহ, আয়মান আহাদ, সাইফ নেওয়াজ, মো. আল সাহারিয়ার, মো. হেলাল উদ্দিন, খুলনা পাবলিক কলেজের শাদমান রাশিদ, ইহফাজ আবতাহি আফফান, সেন্ট জোসেফ হাই স্কুলের মো. মাহমুদ আলম, মো. সাইমুন সোহান, রিকু বিশ্বাস, খান জাহিদ আহম্মেদ দ্বীপ, শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজের মর্হর হোসেন মাহিম, সরকারি আযমখান কমার্স কলেজের আহম্মাদ হামিম রাহাত, শেখ রাফসান জানি, মিরাজুল ইসলাম ইমন, হুমায়রা বুশরা, আব্দুল্লাহ গালিব, পাইনিয়ার কলেজের সাদিকুন নাহার, সরকারি ইকবাল নগর মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের লাবিবা সাদাত গল্প, খুলনা কলেজিয়েট গার্লস স্কুল এন্ড কলেজের মোবাশ্বিরা মোজাহিদ সারা প্রমুখ।

জুলাইয়ে খুলনায় শহীদ হন নবপল্লির শেখ মো. শাকিব রায়হান, তেরখাদা উপজেলার আব্দুল হামিদ শেখ, রূপসার ইয়াসিন শেখ, পাইকগাছার নবিনুর মোড়ল ও কালিদাসপুর গ্রামের রকিবুল হাসান গাজী। ৪ আগস্ট ক্ষুব্ধ জনতা আগুন দেয় শেখ বাড়ি, আওয়ামী লীগ অফিস, জেলা পরিষদ ও বেতার ভবনে।

১৯ জুলাই থেকে সারাদেশে সেনা মোতায়েন ও কারফিউ জারি হলেও খুলনার ছাত্রসমাজ রাজপথ দখলে রাখে। রক্তাক্ত এ অধ্যায় শুধু খুলনার নয়, গোটা দেশের গণতন্ত্রকামী মানুষের হৃদয়ে চিরভাসমান এক আন্দোলনের দলিল।

এই আন্দোলন ছিল না শুধুই কোটা সংস্কারের দাবি, বরং তা ছিল গণতন্ত্রের প্রতি এক অপরিসীম দায়বদ্ধতার বহিঃপ্রকাশ। খুলনার রক্তস্নাত পথচলা ইতিহাসে এক গৌরবময় অধ্যায় হয়ে থাকবে, যা নতুন ভোরের, নতুন সম্ভাবনার ও গণতন্ত্রের অগ্নিশিখার প্রতীক হয়ে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আলো দেখাবে।

 

 

মাসুম বিল্লাহ ইমরান

খুলনা ব্যুরো