খুলনা প্রতিনিধি:
অক্টোবরের শেষে মৌসুমি হাওয়ার দিক বদলাতেই নিস্তব্ধ সুন্দরবনের বুকে জেগে ওঠে নতুন প্রাণ। বছরের সাত মাস নির্জন পড়ে থাকা দুবলার চর হঠাৎই পরিণত হয় এক অস্থায়ী জনপদে—যেখানে হাজারো জেলে, শ্রমিক, ব্যবসায়ী, সরবরাহকারী এবং ক্রেতার পদচারণায় প্রাণ ফিরে পায় পুরো বালুচর। যেন বনের গভীরে গড়ে ওঠা একটি ভাসমান শহর। মাত্র পাঁচ মাসেই এখানে গড়ে ওঠে বাজার, দোকান, কর্মশালা, জেটি, মৎস্যঘাট—সব মিলিয়ে এক অস্থায়ী সমাজব্যবস্থা।
জেলেদের ভাষায়, “এই পাঁচ মাসই আমাদের সারা বছরের জীবন।” কারণ এই সময়েই তৈরি হয় প্রায় ৩০–৩৫ কোটি টাকার শুটকি, আর সরকার পায় ৬–৮ কোটি টাকার রাজস্ব। শুধু অর্থনীতিই নয়, পাঁচ মাসের এই জনপদ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের হাজারো পরিবারের জীবনধারা ও খাদ্যনিরাপত্তার একটি বড় স্তম্ভ।
লবণজলের সঙ্গে জীবনের লড়াই
চরে গিয়ে চোখে পড়ে—বালু খুঁড়ে তৈরি করা ছোট নলকূপই এখানে জীবনের প্রধান ভরসা। নোনাধরা সেই পানি দিয়েই রান্না, পান, ধোয়া-মোছা—সবকিছু সেরে নেয় মানুষ। খুলনার কয়রার জেলে আব্দুল হাই কূপ থেকে পানি তুলতে তুলতে বলেন, “আমাদের জীবন চলে এই পানিতে। লবণ হলেও এই পানি ছাড়া উপায় নেই।”
বিদ্যুতের অভাব এখানে দীর্ঘ দিনের বাস্তবতা। কয়েকটি সৌর প্যানেল ও গর্জনরত জেনারেটরই আলোর শেষ ভরসা। সেই শব্দের মধ্যেও চলে দোকান, মোবাইল চার্জ, ওয়েল্ডিং—সব ধরনের কাজই। তবুও মানুষের মুখে হাসি। কারণ দুর্ভোগ এখানে অভিযোগ নয়—জীবনেরই অংশ।
ভোর হলেই অর্থের লড়াই
সূর্য ওঠার আগে থেকেই নেমে আসে কর্মচাঞ্চল্য। কেউ গভীর সমুদ্র থেকে ধরে আনা মাছ নামাচ্ছে, কেউ আবার সেগুলো ধুয়ে শুকানোর প্রস্তুতি শুরু করছে। পাঁচ মাসে এখান থেকে যে ৬৫ হাজার কুইন্টাল শুটকি উৎপাদিত হয়, সেগুলো চলে যায় চট্টগ্রাম, খুলনা, ঢাকাসহ দেশের প্রায় সব বড় বাজারে। শুধুই মাছ নয়—শুটকি পরিবহন, বিক্রি, প্যাকেজিং, নৌপরিবহন—সব মিলিয়ে এক বিশাল অর্থনৈতিক চক্র চালু থাকে এই পাঁচ মাসে।
রামপালের কামরুল ইসলাম, যিনি ১৯৮৮ সালের বন্যার পর থেকে এই পল্লীর সঙ্গে যুক্ত, বলেন, “মাছ ভালো মিললে আনন্দই আলাদা। না মিললে খালি জাল, কিন্তু পরদিন আবার নতুন করে সমুদ্রে নামতেই হবে।”
শিশুশ্রম কমেছে, তবুও পুরোপুরি হারায়নি
দুবলার চরের শুটকি পল্লীতে আগে শিশুশ্রম ছিল ব্যাপক। এখন সেটি অনেকটাই কমেছে বলে জানান জেলেরা। তবুও পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। অর্থনৈতিক অনটন অনেক পরিবারকে বাধ্য করে সন্তানদের এই মৌসুমি যুদ্ধে পাঠাতে।
কয়রার কিশোর ইয়াসিন জানায়, “কত বেতন পাব জানি না, তবে সবাই ভালো। কাজ শিখছি।

পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়া সাব্বির এখন শুটকি শুকানোর ঘরের একজন শ্রমিক। রোদ, লবণ, বালু—সবই এখন তার বড় হওয়ার অংশ।
ঝড়ের ছায়া সারাক্ষণ
দুবলার চরের প্রতিটি রাত কাটে ভয়ের মধ্যে। নভেম্বর মানেই ঘূর্ণিঝড়ের স্মৃতি—সিডর, আইলা, মহসেনের দগদগে স্মৃতি এখনও জীবন্ত।
রামপালের সিরাজ বলেন, “জোয়ার এলে ঘর তলিয়ে যায়। সিগনাল না থাকলে বুঝতেই পারি না ঝড় আসছে কিনা। তবুও আসতেই হয়। এই পাঁচ মাসের আয়েই বাকি সাত মাস চলে।”
ঝড়ের সময়ে বন বিভাগ থেকে মাইকিং, টহল এবং জরুরি নৌকা প্রস্তুত থাকে। তবে জেলেদের মতে, সতর্কতা ভালো হলেও অবকাঠামোগত নিরাপত্তা আরও বাড়ানো জরুরি।
নিউ মার্কেট—এক অস্থায়ী শহরের প্রতিচ্ছবি
চরের মাঝখানে গড়ে ওঠা ‘নিউ মার্কেট’ যেন মিনি শহর। বিক্রি হয় নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্য—সবজি, মাছ, শুকনো খাবার, মসলা, পোশাক, মেরামতের সামগ্রী। বিক্রেতারা দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসে পাঁচ মাসের জন্য এখানে দোকান বসান।
সাতক্ষীরার তালার সমিরণ দাস বলেন, “গ্রামে সাত মাস ব্যবসা করি, পাঁচ মাস এই চরেই। এই চরই আমাদের জীবন।”
সরকারি রাজস্ব বৃদ্ধি

সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. রেজাউল করিম চৌধুরী জানান, গত মৌসুমে (২০২৪–২৫) দুবলার চরের শুটকি পল্লী থেকে রাজস্ব এসেছে ৬ কোটি টাকার বেশি।
২০২৫–২৬ মৌসুমে লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৮ কোটি টাকা।
তিনি বলেন, “পর্যটন, জেলে নিরাপত্তা, শুটকি উৎপাদন—সবই এবার আরও নিয়মতান্ত্রিকভাবে চলছে। পরিবেশ সুরক্ষায়ও আমরা কঠোর।” পর্যটনের সম্ভাবনা ও নতুন অভিজ্ঞতা
প্রতিবছর কাতলা উৎসবকে কেন্দ্র করে হাজারো পর্যটক ভিড় করেন দুবলার চরে। শিল্প, প্রকৃতি ও মৎস্যজীবনের সমন্বয় এক অনন্য অভিজ্ঞতা দেয় দর্শনার্থীদের। খুলনার পর্যটক ফারজানা রহমান ময়না বলেন,
“আগেও এসেছি, তবে এবার অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ ভিন্ন—সবকিছু অনেক গুছানো। পুরো দ্বীপটি অত্যন্ত পরিস্কার। শুটকি পল্লীতে একটিও মাছি নেই—এটা সত্যিই বিস্ময়কর।”
দুবলার চরের গল্প—অস্থায়ী জীবনের স্থায়ী সংগ্রাম
দুবলার চর শুধু অর্থনীতির গল্প নয়; এটি মানুষের অভিযোজন, ধৈর্য আর প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকার এক অনন্য ইতিহাস।
ঝড়, লোনা জল, দুর্ভোগ—সবকিছুর মাঝেও এখানে প্রতিদিন জন্ম নেয় নতুন আশার আলো, নতুন স্বপ্ন।
সামান্য বালুচর থেকে গড়ে ওঠা এই ভাসমান জনপদই প্রমাণ করে—বাংলাদেশের উপকূলীয় মানুষের শক্তি কেবল বেঁচে থাকার নয়, বাঁচিয়ে রাখারও।

আরও পড়ুন
রংপুরের তেজপাতা চাষ করে স্বাবলম্বি
হাসিনার মৃত্যুদণ্ড রায়ে খুলনায় উৎসব ও উত্তেজনা
হাসিনার ফাঁসি চাইলে শহীদ আবু সাঈদের মা বারা