নিজস্ব প্রতিবেদক:
বিদেশ পাড়ি দিলে উচ্চ বেতনে চাকরি, উন্নত জীবন আর নানা রকম প্রলোভন দেখিয়ে বিভিন্ন দেশে পাচার করা হয় নিরীহ মানুষকে। বিদেশে আটকে রেখে চালানো হয় নির্যাতন। সেই নির্যাতনের অডিও-ভিডিও দেশে স্বজনদের কাছে পাঠিয়ে অর্থ আদায় করা হয়। শুধু এই নয়; মানব পাচারকারীদের সহায়তায় বিদেশে বাংলাদেশিরা অপহরণেরও শিকার হচ্ছে। এছাড়া মানবপাচারকারীদের ফাঁদে পড়ে শত শত নারী-পুরুষ দুর্ভোগ আর যন্ত্রণাদায়ক পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছেন। এমনকি হারাচ্ছেন জীবনও। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) তথ্য অনুযায়ী, গত দশ মাসে ১৪৫টি মামলা হয়েছে। এমন প্রতারণার শিকার হয়ে অনেক ভুক্তভোগী পরিবার প্রতিকার ও সহযোগিতা চেয়েছেন।
এদিকে নারীদের সঙ্গে প্রতারণার জন্য নতুন কৌশলের আশ্রয় নিচ্ছে পাচারকারীরা। নারীপাচারকারীরা কৌশল পাল্টে এখন মাজারকে নিশানা করেছে। দেশের বিভিন্ন মাজারে আসা-যাওয়া করা নারী, যাঁরা বয়সে তরুণী, তাঁদের চাকরির প্রলোভন দিয়ে ভারতে পাচারের নতুন ঘটনা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর নজরে এসেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, টিকটক, লাইকির মতো অ্যাপ ব্যবহার করে তৈরি নাটক, সিনেমায় অভিনয়ের কথা বলে তরুণীদের ভারতসহ বিভিন্ন দেশে পাচারের ঘটনায় সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তারের পর পাচারকারীরা এখন ধর্মীয় লেবাসে অপকর্মে নেমেছে। মাজারকেন্দ্রিক পাচারকারীচক্র নারীদের ভারতের আজমির শরিফ দরগাহ জিয়ারত করে পুণ্য লাভ করার বা চাকরি দেওয়ার কথা বলে ফাঁদে ফেলছে। এভাবে পাচারের শিকার কয়েকজন তরুণীকে সম্প্রতি দেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে।
এদিকে, বিয়ে করে ভারতে পাচারের ঘটনা পুরনো একটি বিষয়। এখনো সেটি অব্যাহত রয়েছে। এছাড়া বছর দুয়েক আগে পাচারকারীচক্রের সদস্যরা নাটক-সিনেমার পরিচালক সাজতে শুরু করে। টিকটক ও লাইকি অ্যাপ ব্যবহার করে নাটক, সিনেমা বা গানের ভিডিও কনটেন্ট তৈরি করে অনলাইনে প্রচার করা হয়। দরিদ্র তরুণীদের তারকা বানানোর প্রলোভন দিয়ে ভারতে শুটিংয়ের কথা বলে নিয়ে যেত। আর সেখানে নিয়ে তারা তাদের বিভিন্ন পতিতালয়, ড্যান্স ক্লাবে বিক্রি করে দিত। কয়েক মাস আগে ভারতে বাংলাদেশি এক তরুণীকে নির্যাতনের ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর টিকটক হৃদয় চক্রের অনেক সদস্য ধরা পড়ে। তখন জানা যায়, চক্রটি ভারত হয়ে মধ্যপ্রাচ্যে নারীদের পাচার করত। তবে এ ধরনের চক্রের অনেক সদস্যই এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে।
সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, যে চক্রটি একসময় দেশে টিকটক কনটেন্টে নায়িকা বানানোর কথা বলে ভারতে নারী পাচার করত, তারাই এবার কৌশল পাল্টে ধর্মীয় লেবাস নিয়ে দেশের বিভিন্ন এলাকার মাজারের দিকে নজর দিয়েছে। তারা সহজ-সরল নারীদের নিশানা করে। এরপর তাদের পুণ্য লাভের জন্য ভারতের আজমির শরিফে যাওয়ার পরামর্শ দেয়। এ ক্ষেত্রে তারা নিজেরাই যাওয়া-আসার খরচ দেওয়ার কথা বলে তরুণীদের রাজি করায়। তরুণীরা বিনা পয়সায় ভারতে যাওয়া-আসার লোভে পড়ে রাজি হয়ে যান। এ ছাড়া মাজারে চাকরি দেওয়ার প্রলোভনও দেয় তারা। এতে দরিদ্র তরুণীরা ফাঁদে পা দিয়ে ফেলেন।
অন্যদিকে, প্রতিবেশী দেশের পাচারকারী চক্র বাংলাদেশের ভাগ্য বিড়ম্বিত নারী ও শিশুদের সরলতা ও অসচেতনতাকে পুঁজি করে তাদের বিক্রি করে দিচ্ছে যৌনপল্লিতে। ফলে ভারতের যৌনপল্লিগুলোতে শিশু, কিশোরী ও নারীর সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের যশোর, সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট ও কুষ্টিয়ার লোকজন এই প্রতারণার শিকার হচ্ছে।
র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের প্রধান কমান্ডার খন্দকার আল-মঈন বলেন, কারা কিভাবে নারী পাচার করছে, কী কৌশল নিচ্ছে, সেদিকে র্যাবের গোয়েন্দা নজরদারি অব্যাহত আছে। কিছুদিন আগে ইরাকে নারীপাচারকারীদের বিষয়ে তথ্য পাওয়া গেছে। তাদের ভালো বেতনের চাকরির প্রলোভন দিয়ে পাচার করা হয়েছে। এ ধরনের তথ্য সংগ্রহ করে আমরা অভিযান পরিচালনা করছি।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, মানবপাচার ঠেকাতে মন্ত্রণালয় কাজ করে যাচ্ছে। পাচারের শিকার হওয়া নারী-পুরুষদের বিদেশ থেকে ফেরত আনতে মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা যোগাযোগ করেন। বিভিন্ন এনজিও এ নিয়ে কাজ করে।
এদিকে মানবপাচারের মূল কারণসমূহ চিহ্নিত করতে জাতিসংঘের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশ। সম্প্রতি জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি রাবাব ফাতিমা বলেন, জলবায়ু ঝুঁকি, সংঘাত, বাস্তুচ্যুতিসহ বিভিন্ন কারণে মানবপাচার ঘটছে। মানবপাচারের মূল কারণসমূহ অবশ্যই আমাদের চিহ্নিত করতে হবে। জাতিসংঘ সদরদপ্তরে ২২ থেকে ২৩ নভেম্বর অনুষ্ঠিত একটি বৈঠকে মানবপাচার রোধে জাতিসংঘের গ্লোবাল প্ল্যান ফর অ্যাকশান এর মূল্যায়ন বিষয়ক সাধারণ পরিষদের উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে জাতীয় তথ্য তুলে ধরার সময়ে তিনি এ কথা বলেন। তিনি মানবপাচারকে ভয়াবহ অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করে বলেন, এটি মানবাধিকার ও মানবিক মর্যাদার মৌল নীতির অপমান।
জাতিসংঘ দূত মানবপাচার রোধে জেরালো আইনি কাঠামো, বহুপক্ষীয় অংশীদারিত্ব ও কার্যকর আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বৈঠকে মানবপাচার রোধে বাংলাদেশ সরকারের নেয়া বিভিন্ন আইন, নীতি ও প্রাতিষ্ঠানিক পদক্ষেপ তুলে ধরেন। তিনি বলেন, এসডিজি বাস্তবায়ন পরিকল্পনার সাথে সমন্বিত করে ধারাবাহিক যে জাতীয় কর্ম পরিকল্পনা এবং জাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনা করা হয়েছে তাতে মানবপাচার সফলতার সাথে রোধ করা যাচ্ছে। মানবপাচার বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং ক্ষতিগ্রস্তদের সহযোগিতায় এনজিও, সুশীল সমাজ ও কমিউনিটি ভিত্তিক অন্যান্য সংস্থাসমূহের ভূমিকার কথা স্বীকার করে তিনি শ্রমিক পাচার কমাতে শ্রম অভিবাসন বিষয়ে আঞ্চলিক ও আর্ন্তজাতিক সহযোগিতা জোরদারের আহ্বান জানান।
আরও পড়ুন
আগামীকাল লন্ডন যাচ্ছেন খালেদা জিয়া
বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে স্টারলিঙ্ক ইন্টারনেট সেবা চালু করতে যাচ্ছেন ইলন মাস্ক
শক্তিমান অভিনেতা প্রবীর মিত্র আর নেই