নিজস্ব প্রতিবেদক :
একজনের কোমরে পিস্তল ঝোলানো, একজনের হাতে ওয়াকিটকি। আরেকজনের হাতে থাকে হ্যান্ডকাফ। সবার গায়েই ডিবি পুলিশের জ্যাকেট। রাস্তায় চেকপোস্ট বসিয়ে রীতিমতো তল্লাশি চালাতো তারা। কিন্তু তারা কেউ সত্যিকারের পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য নন। ডাকাতি-ছিনতাইয়ের উদ্দেশ্যে ডিবি পুলিশের ছদ্মবেশ ধরতো তারা। রাজধানী ঢাকা ও আশপাশের জেলা শহরের নির্জন রাস্তায় তারা এসব করে বেড়াতো। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের একটি দল গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় মোহাম্মদপুরের বছিলা এলাকা থেকে এই চক্রের চার সদস্যকে গ্রেফতার করেছে। গ্রেফতারকৃতরা হলো- মানিক ব্যাপারী ওরফে দারোগা মানিক (৩৫), জাহিদ হাসান ওরফে রেজাউল (২৮), ফারুক হোসেন ওরফে নাসির উদ্দিন (৪০) ও রুবেল সিকদার ওরফে রুস্তম (৩০)। তাদের কাছ থেকে ডিবি পুলিশ লেখা জ্যাকেট, একটি বন্দুক, একটি খেলনা পিস্তল, ওয়াকিটকি, একটি ওয়ারলেস সেটসহ ডাকাতি ও ছিনতাইকাজে ব্যবহৃত ধারালো অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (উত্তর) হারুন অর রশিদ জানান, গ্রেফতারকৃতরা সংঘবদ্ধ ডাকাত ও ছিনতাইকারী দলের সদস্য। তারা ঈদুল আযহা উপলক্ষে পশুর হাটে আগত ব্যাপারী ও ক্রেতাদের ডাকাতি-ছিনতাই করার পরিকল্পনা করছিলো। তারা ডিবি পুলিশ পরিচয় দিয়ে রাজধানী ও আশপাশের এলাকায় চেকপোস্ট বসিয়ে তল্লাশির নামে সর্বস্ব লুটে নিতো। পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, একটি চক্র দীর্ঘদিন ধরে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে ডাকাতি-ছিনতাই করে আসছিল। কিন্তু ডিবি পুলিশ বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া সবসময় বা সব জায়গায় চেকপোস্ট বসায় না। পুলিশ পরিচয়ে কেউ তল্লাশি করতে চাইলে তার পরিচয় নিশ্চিত করার আহ্বান জানান তিনি। আশপাশে পোশাকে অন-ডিউটিতে থাকা অন্য পুলিশ সদস্যদের মাধ্যমে পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার কথাও বলেন তিনি। গোয়েন্দা পুলিশের কর্মকর্তারা জানান, এই চক্রের মূলহোতা হলো ‘মানিক দারোগা’। ডিবি পুলিশ পরিচয়ে ডাকাতি-ছিনতাই করার সময় সে টিম লিডার হিসেবে নিজেকে দারোগা বা সাব-ইন্সপেক্টর পরিচয় দিতো। এজন্য চক্রের সবাই তাকে মানিক দারোগা বলে ডাকে। এই চক্রের সদস্যরা একাধিকবার ডিবি পরিচয়ে ডাকাতি-ছিনতাই করতে গিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হয়েছে। কিন্তু গ্রেফতারের পর কিছুদিন কারাগারে থাকলেও আদালতের মাধ্যমে জামিন নিয়ে বাইরে এসে আবারও একই কাজে লিপ্ত হতো তারা। গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, গত ৭ জুন গাজীপুরের লিবার্টি নিট ওয়্যার নামে একটি গার্মেন্টস কারখানার দুই কর্মকর্তা শাহজালাল ইসলামি ব্যাংকের শফিপুর শাখা থেকে ১৯ লাখ ২৫ হাজার টাকা তুলে মোটরবাইক যোগে কারখানায় ফিরছিলেন। কারখানার শ্রমিক ও স্টাফদের বেতন দেওয়ার জন্য তারা টাকা তুলে নিয়ে যাচ্ছিলেন। ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা তুলে নেওয়ার খবর পেয়েছিল এই ভুয়া ডিবি পুলিশের চক্রটি। তারা চান্দরা পল্লীবিদ্যুৎ অফিসের পাশে সাধারণ পুলিশ সদস্যের মতোই একটি চেকপোস্ট বসিয়ে মোটরবাইক আরোহী দুই গার্মেন্টস কর্মকর্তাকে আটক করে। অস্ত্রের মুখে তাদের দ্রুত গাড়িতে তুলে মারধর করে টাকার ব্যাগটি ছিনিয়ে নিয়ে যায়। এ ঘটনায় ওই গার্মেন্টস কারখানার ডেপুটি ম্যানেজার জসিম উদ্দিন বাদী হয়ে কালিয়াকৈর থানায় একটি মামলা দায়ের করেছে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, ভুয়া ডিবি পুলিশের এই চক্রটিকে গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে তারা গাজীপুরের ওই ঘটনাটি স্বীকার করেন। গার্মেন্টস কারখানার বেতন-ভাতার সেই টাকা ছিনিয়ে নেওয়ার পর তারা ছয়জন ভাগ করে নেন। টিম লিডার ‘দারোগা মানিক’ নিয়েছিলেন ৫ লাখ। বাকিরা কেউ ২ লাখ কেউ ৩ লাখ করে ভাগ করে নিয়েছেন। গোয়েন্দা পুলিশের ওই কর্মকর্তা জানান, ঈদকে কেন্দ্র করে এই গ্রুপটি আবারও রাজধানীতে গরুর হাটে আগত ক্রেতা ও বেপারীদের টার্গেট করে মাঠে নেমেছিল। পুলিশ পরিচয়ে অস্ত্র ঠেকিয়ে গাড়িতে তুলে সবকিছু ছিনিয়ে নিয়ে নির্জন রাস্তায় নামিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল তাদের। এজন্য চক্রের সদস্যরা বিভিন্ন গরুর হাটে রেকি করা শুরু করেছিল। গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, এই চক্রের একাধিক ব্যক্তি বিভিন্ন ব্যাংকে গিয়ে কে বেশি পরিমাণ টাকা তুলছে তা রেকি করে। গাজীপুরের ঘটনাটির আগে তাদের স্বাধীন নামে একজন সদস্য তিন দিন ওই ব্যাংকে গিয়ে ঘোরাঘুরি করেছে। কেউ বেশি পরিমাণ টাকা তুললেই মোবাইল ফোনে তাদের শারীরিক বর্ণনা বা পোশাকের রঙ বলে দেয় সহযোগী আরেকজনের কাছে। সহযোগী চক্রের এক সদস্য দাঁড়িয়ে থাকে ব্যাংকের সামনে। চক্রের ওই সদস্য পিছু নেয় টাকা তুলে কর্মস্থল বা বাসায় ফেরা ব্যক্তির। তারপর চক্রের অপর সদস্যরা দ্রুত গাড়ি নিয়ে কোনও একটি নির্জন জায়গা বেছে নিয়ে চেকপোস্টের নামে তল্লাশি শুরু করে। গোয়েন্দা পুলিশ জানায়, গ্রেফতারকৃত চারজনের নামে রাজধানী ও আশপাশের বিভিন্ন থানায় একাধিক মামলা রয়েছে। এর মধ্যে মানিকের নামে দুটি, রেজাউলের নামে দুটি, ফারুকের নামে একটি ও রুবেলের নামে সাতটি মামলার তথ্য পেয়েছে গোয়েন্দা পুলিশ। গ্রেফতারের পর তাদের বিরুদ্ধে মোহাম্মদপুর থানায় অস্ত্র আইনসহ পৃথক দুটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের তেজগাঁও জোনের অতিরিক্ত উপকমিশনার শাহাদাত হোসেন সুমা জানান, এই চক্রের আরও বেশ কয়েকজন সদস্যের নাম-পরিচয় পাওয়া গেছে। তাদের গ্রেফতারের জন্য অভিযান চালানো হচ্ছে।
আরও পড়ুন
৪ দাবিতে প্রতীকী অনশন কর্মসূচি পালন করেছে উর্দুভাষীরা
শীতে রোগমুক্ত জীবন পেতে সাহায্য করবে যেসব ভেষজ
অন্যতম দর্শনীয় স্থান মহামায়া লেক