নিজস্ব প্রতিবেদক :
বছর বছর দেশে চালের উৎপাদন বাড়লেও ভোক্তা পর্যায়ে দাম কমছে না। বরং অন্য সময়ের চেয়ে দাম এখন সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে। গত বছরের একই সময়ের চেয়ে এবার চালের দাম বেড়েছে গড়ে ১২ শতাংশ। খোদ সরকারি হিসাব অনুযায়ী গত জুন মাস থেকে এখন পর্যন্ত চালের দাম প্রায় ১০ শতাংশ বেড়েছে। অথচ দেশে এ বছরও রেকর্ড পরিমাণ বোরো ধান উৎপাদন হয়েছে। এমনকি ইন্দোনেশিয়াকে টপকে বাংলাদেশ বিশ্বের তৃতীয় চাল উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে জায়গা করে নিতে যাচ্ছে। কিন্তু ভোক্তা পর্যায়ে চালের দাম নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দুশ্চিন্তায় সরকার। পরিস্থিতি সামাল দিতে বেসরকারিভাবে ২৫ শতাংশ আমদানি শুল্কে ১০ লাখ টন সেদ্ধ চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। খাদ্য এবং কৃষি মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্যানুযায়ী এক মাসের ব্যবধানে মোটা চালের দাম ৪ শতাংশ এবং সরু ও মাঝারি চাল প্রায় ২ শতাংশ বেড়েছে। তবে গত বছরের একই সময়ের চেয়ে সরু ও মাঝারি চাল ১২ শতাংশ ও মোটা চাল ১৩ শতাংশ বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। সপ্তাহের ব্যবধানে পাইকারি বাজারে সব ধরনের চালের দাম প্রায় ২ শতাংশ বেড়েছে। তবে খুচরা বাজারে অপরিবর্তিত রয়েছে। যদিও বিশ্ববাজারে চালের দাম সপ্তাহের ব্যবধানে ২ থেকে ৫ শতাংশ কমেছে। বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি টন চাল ৩৬৩ ডলার থেকে ৪১০ ডলার। ওই হিসাবে প্রতি কেজি চালের দাম পড়ছে ৩০ টাকা থেকে ৩৫ টাকা। ওই চাল দেশে আনার পর প্রতি কেজির দাম পড়বে ৩৩ টাকা ৪৮ পয়সা থেকে ৪০ টাকা। অথচ দেশের বাজারে মোটা চালের দাম বিশ্ববাজারের চেয়ে কেজিতে ১০ টাকা বেশি। এমনকি প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকেও রপ্তানি চালের মূল্য প্রতি কেজি ৩০ টাকা ৮০ পয়সা। ওই হিসাবে দেশের বাজারে কেজিতে মোটা চালের দাম ২০ টাকা ও সরু চালের ৪০ টাকা বেশি।
সূত্র জানায়, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্যানুযায়ী ২০২০ সালের ডিসেম্বর থেকে চলতি বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত দেশে চালের চাহিদা মিটিয়ে আরো ৩০ লাখ টন চাল উদ্বৃত্ত থাকার কথা। দেশে প্রতি মাসে ২০ লাখ ২৮ হাজার টন চালের চাহিদা রয়েছে। ওই হিসাবে বছরে দেশে চালের চাহিদা প্রায় ২ কোটি ৪৩ লাখ ৩৬ হাজার টন। কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী এবার বোরোতে চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২ কোটি ৫ লাখ ৮১ হাজার ৩০০ টন। কিন্তু উৎপাদন হয়েছে ২ কোটি ৮ লাখ ৮৫ হাজার ২৬২ টন, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৩ লাখ ৩ হাজার ৯৬২ টন বেশি। এর আগে একক কোনো ফসলের এমন উৎপাদন হয়নি। আর খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, ১৩ জুলাই পর্যন্ত ১২ লাখ ৮৭ হাজার টন মজুদ ছিল। বাম্পার ফলনেও খাদ্য মজুদ ও সংগ্রহ কম থাকায় এবার সরকার আমদানি বাড়াচ্ছে। যদিও গত কয়েক বছর বেসরকারিভাবে চাল আমদানি নিরুৎসাহিত করে আসছিল সরকার।
সূত্র আরো জানায়, গত এক বছরের চালের দাম লক্ষ্য করলে দেখা যায় চলতি মাসে গড়ে চালের দাম ১০% বেড়েছে। মধ্যস্বত্বভোগীর কাছে কী পরিমাণ মজুদ আছে ওই বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করার জন্য সব জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন হয়েছে। অবৈধ মজুদকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সব জেলায় চিঠি পাঠানো হয়েছে। আর সরকার যদি গুদামে পর্যাপ্ত পরিমাণ চাল সংগ্রহ করতে পারে, তাহলে মিলার কিংবা মজুদদার চক্র তৎপরতা দেখাতে পারে না। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সরকার বাধ্য হয়ে বিদেশ থেকে চাল আমদানি করে মজুদ পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছে। যাতে অসাধু চক্র বাজার ব্যবস্থায় প্রভাব খাটানো কমাতে পারে।
এদিকে চালের দাম প্রসঙ্গে বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাসকিং মিল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক লায়েক আলী মতে, গত মাসের শেষভাগ থেকে মিল পর্যায়ে চালের দাম বাড়তে শুরু করে। এর বড় কারণ ভরা মৌসুম থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত ধানের দাম মণপ্রতি গড়ে ৩০০ টাকা বেড়েছে। ওই কারণে চালের দাম বেড়েছে। যদিও দেশে এবার ধানের বাম্পার ফলনের রেকর্ড গড়েছে। কিন্তু এখনো বিভিন্ন মহাজনের কাছে অনেক ধান মজুদ রয়েছে। ধানের দাম কমলে বাজারে চালের দামও কমবে।
অন্যদিকে এ প্রসঙ্গে খাদ্য সচিব ড. নাজমানারা খানুম জানান, ৬ লাখ ৫০ হাজার টন ধান, ১০ লাখ টন সেদ্ধ চাল এবং এক লাখ টন আতপ চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ৪০ শতাংশ ধান ও ৫৭ শতাংশ চাল সংগ্রহ হয়েছে। আগামী নভেম্বর পর্যন্ত স্বাভাবিক বিলি বিতরণে প্রায় ৯ লাখ টন চাল লাগবে। নীতিমালা অনুযায়ী ১০ লাখ টন মজুদ রাখতে হয়। সেক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ সংগ্রহের মাধ্যমে প্রায় ৫ লাখ টন আর বৈদেশিক সংগ্রহের মধ্যে প্রায় ৫ লাখ টন সংগ্রহ হবে। কিন্তু তা বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য পর্যাপ্ত নয়। বরং কৃষককে ধানের ন্যায্যমূল্য প্রদানের পাশাপাশি বেসরকারি পর্যায়ে আমদানি বাড়াতে হবে।
এ প্রসঙ্গে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার জানান, পর্যাপ্ত উৎপাদনের পরও বাজারে চালের দাম ঊর্ধ্বগতি। অবৈধভাবে ব্যবসা করে এমন মধ্যস্বত্বভোগীদের কাছে এখনো ধান মজুদ আছে। যদি বেসরকারিভাবে নন-বাসমতি, সেদ্ধ-আতপ সরু চাল আমদানি করা হয় তাহলে বাজার কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসবে।
একই প্রসঙ্গে কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক জানান, সরকারের গুদামে যখন চাল থাকে না তখনই ব্যবসায়ীরা বাজার অস্থিতিশীল করে। যারা চুক্তি অনুযায়ী চাল দেয়নি, তাদের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা এবং কালো তালিকাভুক্ত করতে হবে।
আরও পড়ুন
রমজানে কোনো পণ্যের সংকট থাকবে না: ভোক্তার ডিজি
বাড়তি দামে বিক্রি হচ্ছে খাসি-মুরগি-মাছ
পাঁচ বছর বিরতির পর জাহাজ রপ্তানিতে ফিরলো ওয়েস্টার্ন মেরিন