October 6, 2024

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Thursday, December 8th, 2022, 9:32 pm

বাড়ছে বাণিজ্যের আড়ালে অর্থপাচার, পাচারকৃত অর্থ ফেরানোর চেষ্টাও ব্যর্থ

ফাইল ছবি

নিজস্ব প্রতিবেদক:

বিদেশে টাকা পাচার রোধ, পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনতে আর পাচারকারীদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে একযোগে কাজ করছে রাষ্ট্রের ৮টি সংস্থা। তবুও ঠেকানো যাচ্ছে না পাচার। প্রতি বছর দেশের এসব টাকা পাচার হয়ে চলে যাচ্ছে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সুইজারল্যান্ড, সংযুক্ত আরব আমিরাত, থাইল্যান্ডসহ ১০টি দেশে। আমদানি-রপ্তানিসহ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে কারসাজি আর হুন্ডির আড়ালে অর্থপাচার করছে পাচারকারী সিন্ডিকেট। ফেরত আনা যাচ্ছে না দেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ। গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইনটেগ্রিটির একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের আড়ালে প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে গড়ে ৬৪ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হচ্ছে। সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ থেকে ২০২০, ৫ বছরে পাচারকারীরা ৩ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা পাচার করেছে। যার মধ্যে শুধু ২০১৫ সালে ১ বছরেই দেশ থেকে পাচার হয়ে যায় ৯৮ হাজার কোটি টাকা। পাচারকৃত টাকার পরিমাণ বিবেচনায় দক্ষিণ এশিয়ায় পাচারকারী দেশ হিসেবে দ্বিতীয় স্থানে বাংলাদেশ। উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্যিক লেনদেনের সাড়ে ১৭ শতাংশই কোনো না কোনোভাবে পাচার হচ্ছে বলে দাবি আন্তর্জাতিক সংস্থাটির। এদিকে স্বাধীনতার পর এ পর্যন্ত দেশ থেকে পাচার হওয়া লক্ষ কোটি টাকার মধ্যে মাত্র ২১ কোটি টাকা ফেরত আনা সম্ভব হয়েছে। যদিও পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনতে নানা উদ্যোগ নেয়া হয়েছে কিন্তু সেগুলোতে কাজের কাজ কিছুই হয়নি। সর্বশেষ ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে বিদেশে পাচার করা অর্থ দেশে ফেরত আনার সুযোগ দেওয়া হয়। সাড়ে ৭ শতাংশ কর দিয়ে পাচারকারীরা অর্থ-সম্পদ দেশে ফেরত আনতে পারবেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত এ সুবিধার আওতায় একজনও অর্থ ফেরত আনেনি বলে জানা গেছে। এদিকে বাংলাদেশে বৈদেশিক বাণিজ্যের আড়ালে অর্থপাচার বাড়ছে, তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন খোদ বাংলাদেশ বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর। চলতি মাসের শুরুতে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) তিন দিনব্যাপী উন্নয়ন সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিষয়টি পুনরুল্লেখ করেন গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার। আমদানি-রপ্তানির আড়ালে মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে অর্থ পাচারের বিষয়ে কথা বলেন তিনি। গত কয়েক মাসের আমদানির চিত্র তুলে ধরতে গিয়ে তিনি জানান, বেশি দামের পণ্য কম দামে এলসি খুলে বাকি অর্থ হুন্ডিতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। আবদুর রউফ তালুকদার পণ্য আমদানিতে মিথ্যা ঘোষণার কিছু উদাহরণ দেন। তিনি বলেন, এক লাখ ডলারের মার্সিডিজ বেঞ্জ গাড়ি মাত্র ২০ হাজার ডলারে আমদানির ঋণপত্র খোলা হয়েছে। বাকি অর্থ হুন্ডিতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। আবার আমদানি করা বিভিন্ন পণ্যে ২০ থেকে ২০০ শতাংশ পর্যন্ত ওভার ইনভয়েস (আমদানি মূল্য বাড়িয়ে দেখানো) হয়েছে। গত জুলাই মাসে এমন আশ্চর্যজনক প্রায় ১০০টি ঋণপত্র বন্ধ করা হয়েছে। বৈদেশিক বাণিজ্যে পণ্যের দাম কম বা বেশি দেখিয়ে আমদানি নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে ‘ট্রেড বেজড মানি লন্ডারিং’ বন্ধ করা সম্ভব বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর। বিশ্লেষকরা বলছেন, কম রপ্তানি মূল্য (আন্ডার ইনভয়েসিং) এবং বেশি আমদানি মূল্য (ওভার ইনভয়েসিং) দেখিয়ে বৈদেশিক বণিজ্যের নামে অর্থ পাচার হলো প্রধান কৌশল। এর বাইরে যত পণ্য আমদানির জন্য এলসি খোলা হয় তার চেয়ে কম পণ্য আমদানি করেও অর্থ পাচার করা হয়। এদিকে অর্থ পাচারের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনসহ বিভিন্ন সরকারি সংস্থার দায়ের করা মামলার সংখ্যা বছরের পর বছর ধরে ক্রমেই বাড়ছে। কিন্তু এসব মামলা নিষ্পত্তির হার একেবারেই কম। সূত্রমতে, দেশে ২০০৩ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত মোট অর্থ পাচারের মামলা দায়ের হয়েছে ৯৭৬টি। এসব মামলার মধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে মাত্র ২০৩ টির। এ বছরের অক্টোবর পর্যন্ত গত পাঁচ বছরে অর্থ পাচারের মোট ৩২২টি মামলা দায়ের করা হয়। আর ২০১৬ সালে যে পরিমাণ মামলা দায়ের করা হয়, ২০২১ সালে তার দ্বিগুণ মামলা দায়ের করা হয়েছে। অথচ এই সময়ের মধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে মাত্র ৬৪ টি মামলা। প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে দায়ের করা ৮৫৬টি মামলা বছরের পর বছর ধরে সারা দেশের বিভিন্ন বিচারিক আদালতে ঝুলে আছে। এর আগে ২০০৭ সালে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার অধ্যাদেশ জারি করে দুর্নীতি দমন কমিশনকে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে মামলা এবং তদন্ত করার এখতিয়ার দেয়। এর আগের বিধান ছিল, বাংলাদেশ ব্যাংকের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশ মামলা তদন্ত করবে। ২০১৫ সালে আইনটি সংশোধন করে এ-সংক্রান্ত অপারাধের মামলা দায়ের ও তদন্তে দুদকসহ, পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), কাস্টমস বিভাগ এবং মাদ্রক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরকে এখতিয়ার দেওয়া হয়। দুদকসহ এসব প্রতিষ্ঠানের দায়ের করা ৭৭৩টি মামলার বিচার বছরের পর বছর ধরে ঝুলে রয়েছে। এর মধ্যে দুদকের দায়ের করা মামলার পরিমাণ ৪১৭। ধীরগতিতে নিষ্পত্তির কারণে অর্থ পাচার মামলার স্তূপ জমে উঠছে। সময়মতো বিচারকাজ না হওয়া অর্থপাচার বন্ধ ও পচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনায় ব্যর্থতার অন্যতম কারণ। যারা টাকা পাচার করছে তাদের উপযুক্ত শাস্তি না হওয়ায় পাচারকারীরা সাহস পচ্ছে। এছাড়া সংশ্লিষ্টদের মতে টাকা পাচারের সঙ্গে জড়িতরা নানাভাবে ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে জড়িত থাকে। ফলে যখন যে দলই ক্ষমতায় আসুক না কেন, তারা বিচারের বাইরে থেকে যায় -এটিও একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ। অর্থ মন্ত্রণালয়ের একটি খসড়া গাইডলাইন থেকে জানা গেছে, বিদেশে পাচার করা অর্থ বা সম্পত্তি চিহ্নিত করার পর জব্দ বা বাজেয়াপ্ত করার কৌশল প্রণয়ন নিয়ে কাজ করছে সরকার। পরবর্তী পদক্ষেপ হবে যেখানে অর্থ পাচার করা হয়েছে, সেই দেশগুলোর সঙ্গে যৌথভাবে তদন্ত করে অর্থ ফেরানোর উদ্যোগ নেয়া। সম্পদ জব্দ করতে আদালতের আদেশ পেতে দেরি হলে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) মাধ্যমে লেটার অব রোগেটরি পাঠিয়ে ওই দেশের কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে পাচারকারীর অর্থ বা সম্পদ অন্য দেশে স্থানান্তর প্রক্রিয়া আটকে দেবে করবে সরকার। লেটার অব রোগেটরি হলো, বিচারিক সহায়তার জন্য এক দেশের আদালত থেকে অপর একটি দেশের আদালতের কাছে আনুষ্ঠানিক অনুরোধ। সরকার মনে করছে, এতে অর্থ পাচারকারী ব্যক্তি আর্থিক, মানসিক ও সামাজিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়বে এবং তার তদন্ত প্রভাবিত করার ক্ষমতা সীমিত হয়ে পড়বে, যা দ্রুত ও যথাযথ তদন্তে অত্যন্ত সহায়ক হবে।