অনলাইন ডেস্ক :
এই ম্যাচের আগে কখনোই বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলেননি দাভিদ মালান। তবে এদেশের আলো-হাওয়া আর উইকেটে তার চেয়ে বেশি অভিজ্ঞ কেউ এই ইংল্যান্ড দলে আর কেউ নেই! সেই ২০১৩ সালে প্রাইম দোলেশ্বরের হয়ে ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে খেলেন তিনি। একই দলের হয়ে খেলেন পরের মৌসুমেও। পরে বিপিএল খেলেন চার দফায়। সবশেষটি এই মাস দুয়েক আগে। সেই অভিজ্ঞতার সবটুকু ঢেলে দিয়ে তিনি চ্যালেঞ্জিং উইকেটে দুর্দান্ত এক সেঞ্চুরি করে হতাশ করলেন বাংলাদেশকে। ব্যাটিং ব্যর্থতায় বড় পুঁজি গড়তে পারেনি বাংলাদেশ। তবে লড়াই করেছে বোলিংয়ে। কিন্তু পেরে ওঠেনি মালানের সঙ্গে। দ্বিতীয় ওভারে উইকেটে গিয়ে তিনি ম্যাচ শেষ করে ফেরেন দলের জয় সঙ্গে নিয়ে। তিন ম্যাচ সিরিজের প্রথম ওয়ানডেতে ৩ উইকেটের জয়ে সিরিজে এগিয়ে গেল ইংল্যান্ড। মিরপুর শের-ই-বাংলা স্টেডিয়ামে বুধবার (১লা মার্চ) বাংলাদেশ অল আউট হয় ২০৯ রানে। ইংল্যান্ড জয় পায় ৮ বল আগে। ৮ চার ও ৪ ছক্কায় ১১৪ রানে অপরাজিত থাকেন মালান। ১৪৫ বলে খেলা ৭৮ স্ট্রাইক রেটের ইনিংস খালি চোখে এখনকার ইংল্যান্ড দলের মানসিকতার সঙ্গে বেমানান। তবে এ দিনের উইকেট আর পরিস্থিতির বিচারে অসাধারণ এক ইনিংস। উইকেট এ দিন ছিল ব্যাটিংয়ের জন্য বেশ কঠিন। মন্থর তো ছিলই, সঙ্গে ছিল অসমান বাউন্সও। বল বিপজ্জনকভাবে বাড়তি লাফিয়েছে বারবার। বাংলাদেশের রান তবু ছিল যথেষ্টর কম। একসময় তো আড়াইশ রানও মনে হচ্ছিল খুবই সম্ভব! কিন্তু শেষ পর্যন্ত কেবল নাজমুল হোসেন শান্ত ছাড়া ফিফটি করতে পারেননি কেউ। ওয়ানডে অভিষেকের সাড়ে চার বছর পর এই সংস্করণে প্রথম ফিফটির দেখা পেয়েছেন তিনি ষোড়শ ম্যাচে। সম্প্রতি বিপিএলে সর্বোচ্চ রান করা ব্যাটসম্যানকে দারুণ আত্মবিশ্বাসীও মনে হচ্ছিল। তবে ইনিংস আরও বড় করতে না পারার দায়ও তাকে দেওয়া যায়। ৮২ বলে ৫৮ রানে ফেরেন তিনি। ইংল্যান্ডের পেস-স্পিনের যৌথ আক্রমণ ছিল সফল। ৩ পেসার মিলে নিয়েছেন ৫ উইকেট, ৩ স্পিনার মিলে ৫টি। বাংলাদেশ ব্যাটিংয়ে নামে টস জিতে। ম্যাচের প্রথম বলেই বাড়তি লাফানো ডেলিভারিতে তামিম ইকবালকে অস্বস্তিতে ফেলেন ওকস। পরের বলে তামিম স্ট্রেট ড্রাইভে নেন দুটি রান। পরের সময়টুকুতে এই ধারাই চলতে থাকে। কখনও ওকস-আর্চারের দুর্দান্ত ডেলিভারিত নড়বড়ে ব্যাটসম্যানরা, কখনও তাদের আলগা ডেলিভারিতে বাড়ল রান। শুরুর দিকে রান বাড়ানোর কাজটি করেন তামিম। প্রথম রান করতে লিটনের লেগে যায় ১০ বল। দলের রানের গতি তবু ছিল ভালোই। পঞ্চম ওভারে ওকসের শর্ট বল দৃষ্টিনন্দন পুল শটে ছক্কায় ওড়ান লিটন। তবে ওকস শোধ তোলেন পরের বলেই। লিটনের (১৫ বলে ৭) পাশাপাশি রিভিউও হারায় বাংলাদেশ। তামিম ও শান্ত ধাক্কা সামাল দেওয়ার কাজ ভালোই করছিলেন। নবম ওভারে দলের রান পেরিয়ে যায় পঞ্চাশ। দশম ওভারে প্রথমবার বোলিংয়ে পরিবর্তন আনে ইংল্যান্ড। কাজেও লেগে যায় তা। দেড় বছরের বেশি সময় পর ওয়ানডেতে ফিরে প্রথম ওভারেই উইকেটের স্বাদ পান মার্ক উড। সেটিও চেনা ঢঙয়েই। তার গতি ও বাড়তি লাফানো বল সামাল দিতে পারেননি তামিম (৩২ বলে ২৩)। ব্যাটে লেগে বল ছোবল দেয় স্টাম্পে। শান্ত এবার সঙ্গী হিসেবে পান মুশফিকুর রহিমকে। আরেকটি সম্ভাবনাময় জুটি গড়ে ওঠে। মইন আলির বলে স্লগ সুইপে সীমানায় ধরা পড়েও ফিল্ডার ফিল সল্ট সীমানা স্পর্শ করায় ছক্কা পান মুশফিক। তবে প্রিয় এই শটই পরে ডেকে আনে তার পতন। আদিল রশিদের বলে স্পিনের বিপক্ষে সুইপ করে সহজ ক্যাচ দেন তিনি মিড উইকেটে। ৩৪ বল খেলে অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যান করতে পারেন ১৬ রান। বাংলাদেশ আরও বড় ধাক্কা খায় আরেকটু পর। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের পর ওয়ানডেতে প্রথমবার পাঁচ নম্বরে খেলতে নেমে সাকিব আল হাসান (৮) বোল্ড হয়ে যান মইন আলির বলে বাজে শট খেলে। ১০৬ রানে ৪ উইকেট হারানো দল এরপর পায় ইনিংসের একমাত্র অর্ধশত রানের জুটি। উইকেটে যাওয়ার পরপরই মইনের বলে দারুণ শটে বাউন্ডারির পর সময় নিয়ে থিতু হন মাহমুদউল্লাহ। শান্তও একটু সাবধানী ব্যাটিংয়ে এগোতে থাকেন। ফিফটি পূরণ করেন তিনি ৬৭ বলে। এই জুটির সময় মনে হচ্ছিল, আড়াইশ তো বটেই, আরও বেশি রানও তুলতে পারে বাংলাদেশ। কিন্তু এই জুটি ভাঙা দিয়েই বদলে যায় চিত্র। পরপর দুই ওভারে বিদায় নেন দুজন। রশিদের গুগলিতে শান্ত সজোরে পুল করলেও বল নিচে রাখতে পারেননি। ধরা পড়েন জেসন রয়ের হাতে। জুটি থামে ৮০ বলে ৫৩ রানে। পরের ওভারে উডের লেগ স্টাম্পে থাকা বলে হালকা ব্যাট ছুঁইয়ে ফেরেন মাহমুদউল্লাহ (৪৮ বলে ৩১)। এরপর বাজে শটে বিদায় নেন আফিফ হোসেন। ভারতের বিপক্ষে সিরিজের পর এই ম্যাচ দিয়ে টানা চার ইনিংসে তিনি আউট হলেন দুই অঙ্ক ছোঁযার আগে। ভালো কিছু করতে পারেননি ভারত সিরিজের নায়ক মেহেদী হাসান মিরাজও। ১৮২ রানে ৮ উইকেট হারানো দল দুইশ ছাড়াতে পারেন তাসকিন ও তাইজুলের সৌজন্যে। তবে শেষ পর্যন্ত ১৬ বল আগেই শেষ দলের ইনিংস। ইংল্যান্ডের রান তাড়ার শুরুটাই হয় নাটকীয়। সাকিবকে দিয়ে বোলিং শুরু করে বাংলাদেশ। ইনিংসের প্রথম বলেই অল্পের জন্য ক্যাচ হননি জেসন রয়। দুই বল পর বাউন্ডারি পেয়ে যান তিনি। তবে বিদায়ও নেন প্রথম ওভারেই। ক্রিজ ছেড়ে একটু বেরিয়ে উড়িয়ে মারার চেষ্টায় বিভ্রান্ত হন রয়। মিড অনে সহজ ক্যাচ নেন তামিম। সাকিব ও তাসকিন আহমেদ দুই পাশ থেকে আঁটসাঁট বোলিংয়ে চেপে ধরেন ইংলিশদের। প্রথম ৬ ওভারে রান আসে ১৮। তাইজুল ইসলামকে ছক্কা মেরে মালান চেষ্টা করেন চাপ কমানোর। কিন্তু বাঁহাতি এই স্পিনার পরের ওভারে দুর্দান্ত ডেলিভারিতে বোল্ড করে দেন ফিল সল্টকে। তাইজুল বেশিক্ষণ টিকতে দেননি জেমস ভিন্সকেও। মালান অবশ্য একপ্রান্ত আগলে রাখার পাশাপাশি রানের চাকা সচল রাখেন। সুযোগ পেলেই আলগা বলকে বাউন্ডারিতে পাঠান তিনি। তবে আরেকপ্রান্তে জস বাটলারকেও দ্রুত ফেরায় বাংলাদেশ। ইংলিশ অধিনায়ককে বিদায় করতে তাসকিনকে আক্রমণে ফেরান অধিনায়ক। তিনি প্রথম বলেই সাফল্য এনে দেন বাড়তি লাফানো দুর্দান্ত ডেলিভারিতে বাটলারকে ফিরিয়ে। সপ্তদশ ওভারে ইংল্যান্ডের রান তখন ৪ উইকেটে ৬৫। ম্যাচ দোদুল্যমান। একটু একটু করে তা ইংল্যান্ডের দিকে হেলে পড়ে পরের দুই জুটিতে। মালানের সঙ্গে প্রথমটির সঙ্গী উইল জ্যাকস, পরেরটিতে মইন আলি। দুই জুটিই ৩৮ রানের। দুটিই ভাঙেন মিরাজ। পরে তাইজুল আরেক স্পেলে ফিরে থামিয়ে দেন ক্রিস ওকসকেও। কিন্তু মালানকে থামাবে কে! তাইজুলকে বিশাল ছক্কা মেরেই তিনি সহজ করে তোলেন সমীকরণ। ১৬১ রানে যখন ৭ উইকেট হারায় ইংল্যান্ড, জয় তখনও ৪৯ রান দূরে। কিন্তু এই ইংল্যান্ড দলের ব্যাটিং গভীরতা এমন যে, সঙ্গীর অভাবে পড়তে হয়নি তাকে। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ১০ সেঞ্চুরিতে প্রায় ৭ হাজার রান করা আদিল রশিদ নামেন ৯ নম্বরে! মালান ও রশিদ মিলেই শেষ পর্যন্ত শেষ করেন কাজ। দুজনের অবিচ্ছিন্ন জুটি ৫১ রানের। বাংলাদেশের হয়ে দুর্দান্ত বোলিং করেন তাসকিন আহমেদ। তাইজুল উইকেট পেলেও ছিলেন একটু অধারাবাহিক। তবে সবচেয়ে হতাশ করেন মুস্তাফিজুর রহমান। সহায়ক উইকেটেও পারেননি তিনি ভালো করতে। তবে শেষ পর্যন্ত দায়টা ব্যাটসম্যানদেরই, রানটাই যে ছিল একটু কম!
সংক্ষিপ্ত স্কোর: বাংলাদেশ: ৪৭.২ ওভারে ২০৯ (তামিম ২৩, লিটন ৭, শান্ত ৫৮, মুশফিক ১৬, সাকিব ৮, মাহমুদউল্লাহ ৩১, আফিফ ৯, মিরাজ ৭, তাসকিন ১৪, তাইজুল ১০, মুস্তাফিজ ০; ওকস ৮-০-২৮-১, আর্চার ১০-০-৩৭-২, উড ৮-০-৩৪-২, মইন ৭.২-০-৩৫-২, রশিদ ৯-০-৪৭-২, জ্যাকস ৫-০-১৮-১)
ইংল্যান্ড: ৪৮.৪ ওভারে ২১২/৭ (রয় ৪, সল্ট ১২, মালান ১১৪*, ভিন্স ৬, বাটলার ৯, জ্যাকস ২৬, মইন ১৪, ওকস ৭, রশিদ ১৭*; সাকিব ১০-০-৪৫-১, তাসকিন ৯-১-২৬-১, তাইজুল ১০-০-৫৪-৩, মিরাজ ১০-২-৩৫-২, মুস্তাফিজ ৮-০-৪২-০, শান্ত ১-০-৩-০)
ফল: ইংল্যান্ড ৩ উইকেটে জয়ী
সিরিজ: ৩ ম্যাচ সিরিজে ইংল্যান্ড ১-০তে এগিয়ে
ম্যান অব দা ম্যাচ: দাভিদ মালান
আরও পড়ুন
তামিমের অর্ধশতকে দেড়শ’র আগেই থামল ঢাকা
সুপার ওভারে ইংল্যান্ডকে হারাল বাংলাদেশের মেয়েরা
ভক্তদের বড় সুখবর দিলেন বার্সেলোনা সভাপতি