অনলাইন ডেস্ক :
ফিলিস্তিনে যাদের বয়স ৩০ বছরের কম, তারা কখনোই কোনো নির্বাচনে ভোট দেওয়ার সুযোগ পাননি। অনেকেই বলেছেন, ফিলিস্তিনি নেতৃত্বের প্রতি তাদের আস্থা খুবই কম। সম্প্রতি বিবিসি এমন কিছু তথ্য হাতে পেয়েছে, যেখানে বলা হচ্ছে, এই তরুণ সম্প্রদায় ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংকট সমাধানে যে দ্বি-রাষ্ট্র তত্ত্বের কথা বলা হয়, ক্রমশই তা প্রত্যাখ্যান করছে।‘খুবই গতানুগতিক এই দ্বি-রাষ্ট্র সমাধান পশ্চিমের তৈরি। এখানে বাস্তব পরিস্থিতির দিকে নজরই দেওয়া হয়নি,’ বেশ তাচ্ছিল্যের সঙ্গেই বললেন ১৭ বছর বয়সী জান্না তামিমি। তার পাল্টা প্রশ্ন, ‘সেটাই যদি হবে, তাহলে সীমান্ত কোথায়?’ বিশ্বে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃত সবচেয়ে কম বয়সী সাংবাদিকদের একজন জান্না। মাত্র সাত বছর বয়সে মায়ের টেলিফোন ধার করে অধিকৃত পশ্চিম তীরে তার নিজের শহর নাবি সালাহ থেকে প্রতিবাদের খবর রিপোর্ট করতে শুরু করেন তিনি।
জান্না বলেন, আমি হানা দেওয়ার খবর দেই। এসব অভিযান প্রায়শই চালানো হয়। আমি সবগুলোর ভিডিও তুলতে পারি না, তবে আমার যথাসাধ্য চেষ্টা করি। ইন্তিফাদার প্রতি সমর্থন ঊর্ধ্বমুখী জান্নার জন্মের পর থেকে ফিলিস্তিনি এলাকায় একটিও সাধারণ নির্বাচন বা প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয়নি। শেষবার নির্বাচন হয়েছিল ২০০৬ সালে। অর্থাৎ, ৩৪ বছরের কম বয়সী কেউই জীবনে কখনো ভোট দেওয়ার সুযোগ পাননি। শেষবার ভোটের পর থেকে যেটা হয়েছে তা হলো, ফিলিস্তিনি রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রতি মানুষের আস্থা ভেঙে পড়েছে। একই সঙ্গে দ্বি-রাষ্ট্র সমাধান তত্ত্বের প্রতি সমর্থনের পাল্লাও ক্রমশ নিম্নমুখী হয়েছে। এই তত্ত্বেব ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন দুটি পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের কথা বলা হয়েছে। পশ্চিম তীরে প্যালেস্টাইন সেন্টার ফর পলিসি অ্যান্ড সার্ভে রিসার্চ নামে একটি সংস্থা গত দুই দশকে জনসাধারণের মধ্যে মনোভাবের পরিবর্তন কীভাবে ঘটেছে সে বিষয়ে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেছে। ১৮ থেকে ২৯ বছর বয়সীদের ওপর চালানো এই জরিপের তথ্য তারা বিবিসির সঙ্গে শেয়ার করেছে।
জরিপের ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, ক্ষমতাসীন ফিলিস্তিনি অথোরিটির (পিএ) প্রতি এই প্রজন্মের সমর্থন উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে এবং গত দশকে দ্বি-রাষ্ট্র সমাধান তত্ত্বের প্রতি সমর্থনও নিরবচ্ছিন্নভাবে নিম্নমুখী হয়েছে। সংস্থাটির পরিচালক ড. খালিল শিকাকি বলেন, বর্তমান তরুণ প্রজন্মের মধ্যে অসন্তোষের মূল কারণ হলো রাজনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে তাদের দৃষ্টিতে বৈধতার অভাব। আমাদের একজন প্রেসিডেন্ট রয়েছেন, যিনি ১৪ বছর ধরে নির্বাচনী বৈধতা ছাড়াই শাসন চালিয়ে যাচ্ছেন। ‘আমাদের রাজনৈতিক কাঠামো মূলত কর্তৃত্বপরায়ণ। এই ব্যবস্থা প্রধানত এক ব্যক্তি কেন্দ্রিক। কাগজে কলমে আমাদের একটা সংবিধান রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে আমরা তার তোয়াক্কা করি না।’ একইসঙ্গে, ৩০ বছরের কম বয়সীদের মধ্যে সশস্ত্র সংঘাতের প্রতি সমর্থন খুবই বেশি। এদের ৫৬ শতাংশই ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ইন্তিফাদা বা অভ্যুত্থানের পক্ষে। গত এক বছরে পশ্চিম তীরে উত্তরাঞ্চলীয় দুই শহর নাবলুস এবং জেনিনে অসংখ্য নতুন সশস্ত্র গোষ্ঠী মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে, যারা ক্ষমতাসীন পিএ’র নিরাপত্তা বাহিনীর বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে। এদের মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত হলো লায়ন্স ডেন এবং জেনিন ব্রিগেডস, যারা পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি বাহিনী ও বসতি স্থাপনকারীদের ওপর হামলাও চালিয়েছে।
বলপ্রয়োগের ভাষা : জেনিন বিগ্রেডের সদস্যদের সঙ্গে একদিন মধ্যরাতে যোগ দিয়েছিলেন বিবিসির সংবাদদাতা। তখন তারা জেনিন শরণার্থী শিবিরের গোলকধাঁধাঁর মতো অলিগলিতে প্রশিক্ষণ মহড়া চালাচ্ছিল। দলের প্রত্যেক সদস্যের হাতে ছিল এম১৬ অ্যাসল্ট রাইফেল। তাদের আপাদমস্তক ঢাকা ছিল কালো পোশাকে। নিঃশব্দে তারা এসে দাঁড়ায় একটি লাইনে। বন্দুকগুলো সামনে ধরে অলিগলি আর ছাদের মাথা নিশানা করে তারা এগোতে থাকে। এদের বেশিরভাগই পুরুষ, যাদের বয়স বিশের কোঠায়। তাদের দাবি, তারা কোনো জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত নয় বা তাদের অংশও নয়। তারা স্বাধীনচেতা গোষ্ঠী এবং ফিলিস্তিনি অঞ্চলের রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কোনো ধরনের সংযোগ তারা প্রকাশ্যেই প্রত্যাখ্যান করে থাকে। এই গোষ্ঠীটির একজন যোদ্ধা, ২৮ বছর বয়সী মুজাহিদের মতে, বর্তমান নেতৃত্ব তাদের প্রজন্মের প্রতিনিধিত্ব করে না। তিনি বলেন, গত ৩০ বছরের রাজনৈতিক ব্যবস্থার ওপর ফিলিস্তিনি তরুণরা আর ভরসা রাখতে পারছেন না। তাদের আশাভঙ্গ হয়েছে। তাহলে কি তিনি সহিংস পথে সমাধানে বিশ্বাসী? এ প্রশ্নে তার জবাব, দখলদাররা প্রতিদিন এখানে ঢোকে, প্রকাশ্য দিবালোকে ঠান্ডা মাথায় মানুষ খুন করে। এই দখলদাররা শুধু বলপ্রয়োগের ভাষাই বোঝে।
ধামাচাপার হাতিয়ার : ফিলিস্তিনি এলাকার ভবিষ্যৎ নিয়ে মতপ্রকাশের সুযোগ না পেয়ে বেড়ে উঠেছে যে প্রজন্ম, তাদের কাছে এটা আত্মপরিচয় নিয়ে প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। সংস্কৃতি ও শিক্ষা নিয়ে কাজ করে নিরপেক্ষ একটি সংস্থা কাত্তান ফাউন্ডেশনের কিউরেটর মজিদ নাসরাল্লাহ। তার কর্মস্থল পশ্চিম তীরের রামাল্লা শহরে, কিন্তু তার জন্ম উত্তর ইসরায়েলের একটি শহরে। ইসরায়েলি জনসংখ্যার ২০ শতাংশই হলো ইসরায়েলের আরব নাগরিকরা। তার প্রজন্মের অনেকের মতো তিনিও নিজেকে ‘ফ্রম ৪৮’ হিসেবে পরিচয় দিতে পছন্দ করেন। ‘ফ্রম ৪৮’ বলতে তাদের বোঝায়, যারা ১৯৪৮ সালে যে ভূখ- দখল করে ইসরায়েল রাষ্ট্র হয়েছিল, সেখানেই থেকে গেছেন। ফলে মজিদকে ফিলিস্তিনি সমাজের অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হয় না। তিনি বলেন, পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনি শাসন ব্যবস্থায় আমার কোনো স্বীকৃত স্থান নেই। আমার ভোট দেওয়ার কোনো অধিকার নেই। আসলে, ইসরায়েলের আইন অনুযায়ী আমার এখানে থাকারই কথা নয়। ইসরায়েলি আইনে ইসরায়েলের কোনো নাগরিকের নিরাপত্তার কারণে পশ্চিম তীরের কোনো ফিলিস্তিনি এলাকায় যাওয়া নিষেধ। ফিলিস্তিনের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় তার অংশগ্রহণের সুযোগ না থাকায় মজিদও দ্বি-রাষ্ট্র সমাধান তত্ত্বে বিশ্বাস করেন না। তার কথায়, দ্বি-রাষ্ট্র সমাধানের বিষয়টি আসলে একটি রাজনৈতিক প্রকল্পের মরদেহ মাত্র। ফিলিস্তিনিদের ওপর নিপীড়ন-নির্যাতন চালিয়ে যাওয়ার জন্য ধামাচাপা দেওয়ার হাতিয়ার এটি। ‘আমাকে যদি জিজ্ঞস করেন, আমি বলবো এখানে রাষ্ট্রগঠনের কোনো ব্যাপারই নেই। মানচিত্রের দিকে তাকালে একটা পাঁচ বছরের শিশুও বলে দিতে পারবে, এটি অবাস্তব ও অকার্যকর।’ সূত্র: বিবিসি বাংলা
আরও পড়ুন
টিউলিপের বিকল্প খুঁজছে যুক্তরাজ্য সরকার
দাবানলে পুড়ছে হলিউড হিলস
তিব্বতে ভূমিকম্পে মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৫৩