জেলা প্রতিনিধি, মৌলভীবাজার:
মৌলভীবাজার জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের উচ্চমান সহকারী হিসেবে কর্মরত রয়েছেন মোঃ জাকির হোসেন। ২০০৮ সালে তিনি শিক্ষা অফিসের উচ্চমান সহকারী হিসেবে যোগদান করেই সন্ধান পান আলাদিনের চেরাগ। যোগদানের পরই ঘুষ গ্রহণে বেপরোয়া হয়ে উঠেন তিনি বলে জানা গেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে এই অফিসে তিনি চাকুরী করে বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে বহু সম্পদের মালিক হয়েছেন। মৌলভীবাজারে জায়গা কিনে বাসা বানিয়েছেন।
সূত্র জানায়, বিলাসী জীবন যাপনের জন্য ৩৫ লাখ টাকা দামের নিউ মডেলের একটি গাড়ি কিনেছেন। বিয়েও করেছেন দুটি। দ্বিতীয় স্ত্রীর নামে মৌলভীবাজার সোনালী ব্যাংকে এবং নিজের নামে পূবালী ব্যাংকে করেছেন এফডিয়ার। কাজের মেয়ে হোসনে আরার প্রেমে পড়ে ২০১০ সালে তাকে বিয়ে করেন। মৌলভীবাজারের জগন্নাথপুর এলাকায় দ্বিতীয় স্ত্রী হোসনে আরার নামে ৬ শতক জায়গা কিনে ৩ তলা ফাউন্ডেশন দিয়ে একটি বাসা বানিয়েছেন। তাঁর বাসায় হাতিল সহ দামি ফার্ণিচারে ড্রয়িং রুম সাজানো রয়েছে। ঘরে রয়েছে দামি দামি আসবাবপত্র। সম্প্রতি কুমিল্লায় তার গ্রামের বাড়িতে ছেলের রাজকীয় বিয়ের অনুষ্ঠান করেছেন। গ্রামের বাড়ি কুমিল্লাতেও রয়েছে তাঁর অনেক সম্পদ। গ্রামের বাড়িতে থাকেন প্রথম স্ত্রী।
দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে একই অফিসেই কর্মরত থেকে নানা অভিযোগে ২০১৪ সালে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তাকে বদলি করেন। পরবর্তীতে তদবীর করে ফের ৬ মাসের মাথায়ই তিনি আবার মৌলভীবাজার শিক্ষা অফিসে আবার যোগদান করেন।
সূত্র আরও জানা যায়, নতুন নিয়োগকৃত শিক্ষকদের বাড়ির পার্শ্ববর্তী বিদ্যালয়ে পদায়ন, চাকুরিরত শিক্ষকদের চাহিদা সম্পন্ন বিদ্যালয়ে বদলি (অনলাইন বদলি চালু হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত), শিক্ষকদের অবসর ও মৃত্যু জনিত কাজ সহ বিভিন্ন কাজে জেলায় কর্মরত শিক্ষকদের জিম্মি করে ঘুষ নেন জাকির হোসেন। অনেক দিন অফিসের স্টাফ আসার আগে সকালে আবার কখনও সন্ধ্যায় নীরবে ঘুষ বাণিজ্য করেন জাকির। শিক্ষা অফিসকে তিনি ব্যক্তিগত ব্যবসায় পরিণত করেছেন। উপজেলা অফিস গুলোতেও তার নেতৃত্বে রয়েছে একটি সিন্ডিকেট চক্র। কিন্তু ঔ শিক্ষকরা হয়রানির ভয়ে কেউ প্রতিবাদ করার সাহস করছেন না। তবে এ নিয়ে শিক্ষকদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে।
নাম গোপন রাখার শর্তে মৌলভীবাজার সদর উপজেলার একজন শিক্ষক বলেন, ভোট তোলার দায়িত্বকালীন সময়ে জাকির আমাকে একাধিকবার অনুরোধ করে অপ্রাপ্ত বয়স্ক একটা মেয়ের ভোট তোলান। পরবর্তীতে জানতে পারি ওই মেয়েকে তিনি বিয়ে করেছেন।
সম্প্রতি মৌলভীবাজার সদর উপজেলার এক শিক্ষিকা স্বেচ্ছায় অবসরে যান। নাম গোপন রাখার শর্তে তিনি বলেন, আমার অনেক পরিচয় থাকার পরেও জাকির হোসেনকে ৩ হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে। এভাবে তিনি প্রতিটি কাজে শিক্ষকদের জিম্মি করে টাকা আদায় করেন। অন্যদিকে ২০২৩ সালে নিয়োগপ্রাপ্ত কুলাউড়া উপজেলার একজন শিক্ষক বলেন, আমার বাড়ির পার্শ্ববর্তী বিদ্যালয়ে পদায়ন করে দিবেন বলে জাকির হোসেন আমার কাছে ২০ হাজার টাকা দাবি করেন। টাকা না দেয়ায় আমাকে ওই বিদ্যালয়ে পদায়ন করা হয়নি।
মৌলভীবাজার সদর উপজেলার এক শিক্ষিকা বলেন, আমার এক আত্মীয়কে চাহিদা সম্পন্ন বিদ্যালয়ে পদায়ন করতে না পেরে জাকির হোসেন ঘুষের টাকা ফেরৎ দেন। অবসরে যাওয়া বড়লেখা উপজেলার এক শিক্ষক বলেন, জেলা অফিসে গেলে জাকির কাজ না করে আমাদের বিভিন্ন তারিখ দিয়ে অফিসে আসার কথা বলে বিদায় করে দেন। কয়েকদিন আসা যাওয়া করে বাধ্য হয়ে তাকে টাকা দিয়ে কাজ করিয়েছি। মৌলভীবাজার সদর উপজেলার একাধিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সাথে কথা হলে তারা জাকিরের ঘুষ গ্রহণের কথা স্বীকার করেন।
এ বিষয়ে প্রধান শিক্ষক সমিতির জেলা সভাপতি জহর তরফদার বলেন, অনেক শিক্ষকের মুখ থেকে আমিও এ অভিযোগ শুনেছি। এটা আমাদের অনেক পীড়া দেয়। কিন্তু শিক্ষকরা সরাসরি আমাদের কাছে বলেননি। যার কারণে আমরা অভিযুক্ত ব্যক্তির সাথে কিংবা আমাদের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলতে পারছিনা।
অভিযোগের বিষয়ে মৌলভীবাজার জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের উচ্চমান সহকারী মোঃ জাকির হোসেন জানান, প্রতিদিন নানা কাজে শিক্ষকরা আমার কাছে আসেন। তাদের কাজ করে দিলে অনেকে খুশি হয়ে কিছু টাকা দেন। কারো কাছ থেকে জোর করে কিংবা চুক্তি করে আমি টাকা নেইনি। ব্যাংকের টাকার বিষয়ে তিনি বলেন, প্রধান ডাকঘরে আমার স্ত্রীর নামে একটা সঞ্চয়পত্র ছিল। এটা ভেঙ্গে সোনালী ব্যাংকের কোর্ট শাখায় আমার স্ত্রীর নামে ৫ লক্ষ টাকার এফডিয়ার করে রেখেছি। পূবালী ব্যাংক ওয়াবদা শাখায় মাসিক ৫ হাজার টাকার একটা ডিপিএস রয়েছে। মৌলভীবাজারে বাড়ি এবং গাড়ির বিষয়ে তিনি বলেন, ব্যাংক লোন এবং বন্ধু ও পরিচিত জনদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে এগুলো করেছি।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মোঃ শামসুর রহমান বলেন, উচ্চমান সহকারী জাকিরের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ জেনেছি। বিষয়টি তদন্ত করার জন্য জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের সহকারী শিক্ষা অফিসার কিশলয় চক্রবর্তীকে দায়িত্ব দিয়েছি। তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
আরও পড়ুন
আওয়ামী লীগ দেশের ওলামাদের নিয়ে তাচ্ছিল্য করেছে —রংপুরে শামসুজ্জামান দুদ
রংপুরে এক্্র ক্যাডেটস্্ মিলনমেলা অনুষ্ঠিত
কোম্পানীগঞ্জে অস্ত্রসহ ব্যবসায়ীকে আটক করলো সেনাবাহীনী