প্রায় সব বয়সের লোকেদেরই হাল্কা নাস্তা হিসেবে প্রিয় পছন্দ কেক ও বিস্কুট। জন্মদিন সহ বিভিন্ন উৎসবমুখর অনুষ্ঠানে সবচেয়ে ভালো লাগা উপহারগুলোর মাঝে অনায়াসেই জায়গা করে নেয় এই মিষ্টি জাতীয় খাবারগুলো। কিন্তু খাবারগুলো যে কতটা ক্ষতিকর তা দুঃখজনকভাবে সবার দৃষ্টি এড়িয়ে যায়। নিত্য দিনের খাদ্যাভাসে এই খাবার দু’টির উপস্থিতি দীর্ঘ মেয়াদে ভয়াবহ স্বাস্থ্যহানির কারণ হতে পারে। কিন্তু কেক ও বিস্কুটের বিকল্প হিসেবে এমন কিছু খাবার রয়েছে, যা নিমেষেই মুক্তি দিতে পারে সেই অনাকাঙ্ক্ষিত ঝুঁকি থেকে। চলুন, কেক ও বিস্কুট খাওয়ার ক্ষতিকর দিকগুলোর পাশাপাশি সেই বিকল্প খাবারগুলোর ব্যাপারে বিস্তারিত জেনে নেয়া যাক।
কেক ও বিস্কুট খেলে স্বাস্থ্যের যে ক্ষতি হয়
কেক ও বিস্কুট রক্তে শর্করার মাত্রা বাড়ায়, কারণ এতে থাকে প্রচুর চিনি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অধিক পরিমাণে খাওয়া হলে চূড়ান্ত পর্যায়ে ডায়াবেটিস, স্থূলতা, উচ্চ রক্তচাপ এবং হৃদরোগ হতে পারে।
এ ধরণের বেকারি পণ্যগুলোতে সাধারণত তরল উদ্ভিজ্জ তেল, মাখন, পাম এবং নারকেল তেল ব্যবহার করা হয়। ফলে, এগুলোতে থাকা চর্বিগুলো কম ঘনত্বের কোলেস্টেরল (এলডিএল) বাড়িয়ে দেয়। উল্লেখ্য, পাম তেল সস্তা এবং খাওয়ার জন্য সবচেয়ে ক্ষতিকারক তেলগুলোর মধ্যে একটি। এটি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ক্ষমতা কমিয়ে হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়।
এছাড়া শর্করা এবং স্টার্চ সম্পন্ন খাবারের কারণে দাঁতে ক্যাভিটিস হতে পারে। কেক ও বিস্কুটের কার্বোহাইড্রেট এবং চর্বি ওজন বাড়াতে সহায়তা করে।
সাধারণ মিষ্টি বিস্কুটে প্রতি ২৫ গ্রামে শূন্য দশমিক ৪ গ্রাম লবণ থাকে। অতিরিক্ত লবণ গ্রহণ উচ্চ রক্তচাপ, স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। এছাড়া এতে দেহে পানির পরিমাণ বৃদ্ধি পায়, বিধায় শরীর ভরপুর অনুভূত হয় এবং ওজন বৃদ্ধি পায়।
এ ধরণের বেকারি পণ্যে থাকে বিউটিলেটেড হাইড্রোক্সাইনিসোল (বিএইচএ) এবং বুটিলেটেড হাইড্রোক্সিটোলুইন (বিএইচটি)। এগুলো হলো প্রিজার্ভেটিভস যা মানুষের রক্তের জন্য ক্ষতিকর।
কেক ও বিস্কুটের বিকল্প ৭টি স্বাস্থ্যকর ও সুস্বাদু খাবার
বাদাম
প্রচুর পরিমাণে চর্বি ও ক্যালোরিতে ভরপুর এই বীজ জাতীয় খাবারটি রান্নার পাশাপাশি নাস্তায় খালি মুখেও খাওয়া হয়। বাদামে থাকে অধিক পরিমাণে লিনোলিক অ্যাসিড, ভিটামিন এবং অ্যামিনো অ্যাসিডসহ প্রয়োজনীয় ফ্যাট। অনেক বাদামে ভিটামিন ই, ভিটামিন বি-২, ফোলেট, ফাইবার এবং ম্যাগনেসিয়াম, ফসফরাস, পটাসিয়াম, তামা এবং সেলেনিয়ামের মতো প্রয়োজনীয় খনিজ উপাদান থাকে।
বাদাম হলো অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের সেরা উৎস। বাদামের পলিফেনলসহ অ্যান্টিঅক্সিডেন্টগুলো ফ্রি র্যাডিকেলগুলোকে নিরপেক্ষ করে অক্সিডেটিভ স্ট্রেসের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারে। এই র্যাডিকেলগুলো মূলত অস্থির অণু, যেগুলো কোষের ক্ষতি করে রোগের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
বাদাম এলডিএল কমাতে এবং ট্রাইগ্লিসারাইড বা উচ্চ ঘনত্বের তথা এইচডিএল কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়াতে সাহায্য করে।
হজম সমস্যা এবং টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য বাদাম অন্যতম সেরা খাবার হতে পারে। কেননা প্রথমত, এতে কার্বোহাইড্রেট কম থাকে এবং রক্তে শর্করার মাত্রা খুব বেশি বাড়ায় না।
বাদামের রয়েছে শক্তিশালী প্রদাহ-বিরুদ্ধ বৈশিষ্ট্য। এটি শরীরের আঘাত, ব্যাকটেরিয়া এবং অন্যান্য ক্ষতিকারক প্যাথোজেন থেকে শরীরকে রক্ষা করতে সহায়তা করে।
বাদামে থাকা ফাইবার শরীরকে দীর্ঘক্ষণ যাবত পূর্ণ বোধ করতে সাহায্য করে। ফলে অল্প গ্রহণ করেই খিদে মেটানো সম্ভব হয়, যা ওজন কমানোর জন্য সহায়ক।
ফল
যে কোন সময়ের নাস্তার জন্য ফল একটি স্বাস্থ্যকর ও সুস্বাদু খাবার। বিভিন্ন সময়ের মৌসুমী ও বারমাসি ফলগুলো প্রতিটি দিনকে রোগমুক্ত করতে যথেষ্ট।
আপেল ও জাম্বুরা জাতীয় ফল ফ্ল্যাভোনয়েড, ক্যারোটিনয়েড, ফাইবার, পটাসিয়াম এবং ম্যাগনেসিয়াম সমৃদ্ধ, যা হৃৎপিণ্ডকে হাজার রোগ থেকে রক্ষা করে।
ফলের মধ্যে ফাইবারের উপস্থিতি রক্তের কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ, রেচক বৈশিষ্ট্য বজায় এবং মানবদেহে হজম প্রক্রিয়া সাবলীল রাখে। এমনকি এটি কিডনিতে পাথর তৈরিতেও বাধা দেয়। ফাইবার সমৃদ্ধ ফল যেমন আপেল, কলা এবং আমেও রয়েছে অ্যান্টি-কার্সিনোজেনিক বৈশিষ্ট্য। এই সবকিছু স্থূলতা এবং টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
পটাসিয়াম সমৃদ্ধ কলা, কমলালেবুর মতো ফলে কার্বোহাইড্রেট এবং চর্বি কম থাকায়, এগুলো দেহে স্বাভাবিক রক্তচাপ বজায় রাখতে সাহায্য করে।
ভিটামিন সি সমৃদ্ধ পেঁপে, পেয়ারা ও আমলকি শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে বেশ উপকারী। অধিকন্তু, এগুলোতে কোনও কোলেস্টেরল থাকে না, যা কার্ডিয়াক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক।
ফলে থাকা প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট ত্বকের উজ্জ্বলতা ধরে রাখতে সহায়তা করে। পেঁপে ও নারকেলের মতো ফল বিভিন্ন চর্মরোগের সঙ্গে লড়াই করতে পারে। ভিটামিন এ যুক্ত ফল চুলের স্বাস্থ্য উন্নত করে।
বীজ
দানাদার খাবারের চাহিদা পূরণে বীজ একটি অপরিহার্য খাদ্য উপাদান। বিভিন্ন বীজের মধ্যে তিসি হলো একই সঙ্গে ফাইবার, ওমেগা-৩ ফ্যাট, ও লিগন্যানের যোগানদাতা। এগুলো কোলেস্টেরল, রক্তচাপ এবং এমনকি ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে পারে।
চিয়া বীজ ওমেগা-৩ ফ্যাটের একটি ভাল উৎস, যা কার্যকরভাবে রক্তে শর্করা কমানো এবং হৃদরোগের ঝুঁকির কারণগুলো হ্রাস করে।
শণের বীজে রয়েছে প্রোটিন এবং অ্যামিনো অ্যাসিড। এই বীজের তেল এক্সিমা এবং অন্যান্য দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহজনক অবস্থার লক্ষণগুলো কমাতে সাহায্য করে।
তিলের বীজে থাকা লিগন্যান প্রদাহ এবং অক্সিডেটিভ স্ট্রেস কমানোর জন্য সহায়ক।
কুমড়ার বীজের তেলে আছে ওমেগা-৬ ফ্যাট, আর এটি হার্টের স্বাস্থ্য এবং মূত্রনালীর রোগের লক্ষণগুলো উপশমে সহায়ক ভূমিকা রাখে।
সূর্যমুখী বীজেরও ওমেগা-৬ ফ্যাটের মাত্রা অনেক বেশি। ফলে এটি প্রদাহ এবং কোলেস্টেরলের মাত্রা কমাতে সাহায্য করে।
গাঁজর
কেক ও বিস্কুটের সেরা বিকল্পগুলোর মধ্যে বেশ উপাদেয় একটি সব্জি হলো গাঁজর। কাঁচা গাঁজরে আছে ৮৮ শতাংশ পানি, ৯ শতাংশ শর্করা, শূন্য দশমিক ৯ আমিষ, ২ দশমিক ৮ শতাংশ ডায়েটারি ফাইবার, এবং শূন্য দশমিক ২ শতাংশ চর্বি।
গাঁজরের আলফা এবং বিটা-ক্যারোটিনগুলো আংশিকভাবে ভিটামিন এ-তে বিপাকিত হয়। গাঁজর ভিটামিন কে এবং ভিটামিন বি-৬-এ ভরপুর।
গাঁজর খেলে দীর্ঘ মেয়াদে ক্যান্সার এবং হৃদরোগের ঝুঁকি থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। এছাড়া এটি চোখের স্বাস্থ্যের উন্নতি করে দর্শনেন্দ্রিয়কে সক্রিয় রাখে। উপরন্তু, এই সবজি ওজন কমানোর ক্ষেত্রে একটি কার্যকর খাদ্য-উপাদান।
দই
দই হল দুধের ব্যাকটেরিয়া গাঁজন দ্বারা উৎপাদিত একটি খাদ্য। দই ৮১ শতাংশ পানি, ৯ শতাংশ আমিষ, ৫ শতাংশ চর্বি, এবং ৪ শতাংশ শর্করার সমন্বয়। এর প্রতি ১০০-গ্রাম ৯৭ কিলোক্যালরি খাদ্য শক্তি প্রদান করে। দই ভিটামিন বি-১২ এবং রাইবোফ্লাভিনের একটি সমৃদ্ধ উৎস, যেখানে প্রোটিন, ফসফরাস এবং সেলেনিয়ামের পরিমিত উপাদান রয়েছে।
এতে যথেষ্ট পরিমাণে ক্যালসিয়াম, ভিটামিন বি এবং ট্রেস খনিজ রয়েছে। দই প্রায়ই প্রোবায়োটিকের সঙ্গে যুক্ত থাকে, যা ইমিউন, কার্ডিওভাসকুলার, বা বিপাকীয় স্বাস্থ্যের উপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।
দই এইচডিএল কোলেস্টেরল বাড়িয়ে এবং রক্তচাপ কমিয়ে হার্টের সুস্বাস্থ্য বজায় রাখে। দইয়ে থাকা আমিষ সামগ্রিকভাবে ওজন নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করতে পারে।
চালের কেক
পাফ করা চাল থেকে তৈরিকৃত এই খাবারটিতে রয়েছে ৩৫ ভাগ ক্যালোরি। অন্যান্য পুষ্টি উপাদানের মধ্যে রয়েছে ৭ দশমিক ৩ গ্রাম শর্করা, শূন্য দশমিক ৭ গ্রাম আমিষ, শূন্য দশমিক ৪ গ্রাম ফাইবার, শূন্য দশমিক ৩ মিলিগ্রাম ম্যাঙ্গানিজ, শূন্য দশমিক ৭ মিলিগ্রাম নিয়াসিন, ৩২ দশমিক ৪ মিলিগ্রাম ফসফরাস, ১১ দশমিক ৮ মিলিগ্রাম ম্যাগনেসিয়াম, এবং ২ দশমিক ২ মাইক্রোগ্রাম সেলেনিয়াম।
গোটা শস্যে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার থাকে, যা রক্তে শর্করার বৃদ্ধি প্রতিরোধ করে। এছাড়াও, এই ফাইবার মানবদেহের অন্ত্রে ভাল ব্যাকটেরিয়া সরবরাহ করে। এই ব্যাকটেরিয়া মূলত ডায়াবেটিস এবং স্থূলতার বিরুদ্ধে লড়াই করে।
রাইস কেক স্বাস্থ্যকর ওজন বজায় রাখার জন্য সহায়ক। যেহেতু বাদামী রঙের চালটি প্রাকৃতিকভাবে গ্লুটেন-মুক্ত, তাই যারা গ্লুটেন খেতে পারেন না, তাদের জন্য এই কেক একটি চমৎকার খাবার।
পিনাট বাটার
আমিষে ভরপুর পিনাট বাটার প্রকৃতপক্ষে চিনাবাদাম দিয়ে তৈরি একটি পেস্ট। এর ১০০-গ্রাম ৫৯৭ ক্যালোরি সরবরাহ করতে পারে। এটি ৫১ শতাংশ চর্বি, ২২ শতাংশ আমিষ, ৫ শতাংশ ডায়েটারি ফাইবার সহ ২২ শতাংশ শর্করা, এবং ১ শতাংশ পানি দিয়ে গঠিত।
পিনাট বাটার ফাইবার, ভিটামিন ই, প্যান্টোথেনিক অ্যাসিড, ফোলেট, নিয়াসিন এবং ভিটামিন বি-৬-এর একটি ভালো উৎস। এছাড়াও এতে আছে খাবারের খনিজ ম্যাঙ্গানিজ, ম্যাগনেসিয়াম, ফসফরাস, দস্তা, তামা এবং সোডিয়াম।
চিনাবাদামে কার্বোহাইড্রেট কম থাকে। সে অনুসারে পিনাট বাটার টাইপ-২ ডায়াবেটিস বা কম কার্বোহাইড্রেট ডায়েট অনুসরণকারী ব্যক্তিদের জন্য উপযুক্ত। এতে কিছু রেসভেরাট্রলও রয়েছে, যা হৃদরোগ এবং অন্যান্য দীর্ঘস্থায়ী রোগের ঝুঁকি হ্রাসের প্রধান কারণ।
শেষাংশ
বেশ সহজলভ্য হলেও কেক ও বিস্কুটের উপরোক্ত বিকল্পগুলো স্বাভাবিকভাবেই খাদ্য তালিকার বাইরে থেকে যায়। কিন্তু কয়েক পদের ফলের সালাদ একই সাথে স্বাস্থ্যকর এবং মজাদার একটি আইটেম। বাদাম, বীজ ও দইয়ের সমন্বয়টিও প্রতিদিনি পূরণ করতে পারে সুস্বাদু খাদ্যের চাহিদা। তাছাড়া আলাদাভাবে এগুলো গ্রহণে স্বাস্থ্যগুণের ব্যাপার তো থাকছেই।
অন্যদিকে, স্বল্প পরিমাণে হলেও হর হামেশা কেক ও বিস্কুট খাওয়ার ফলে এক সময় স্থায়ীভাবেই এই মিষ্টান্নগুলো খাওয়া বন্ধ করতে হতে পারে। সর্বসাকূল্যে, স্বাস্থ্য রক্ষার্থে অল্প করে নিত্যদিন যে খাবারগুলো দেহে ঢুকছে তার প্রতি সতর্ক নজর রাখা জরুরি।
—-ইউএনবি
আরও পড়ুন
শীতে শিশুদের সুস্থ রাখবে যেসব খাবার
শীতে ভিটামিন সি’র ঘাটতি মেটাতে যেসব ফল খাবেন
জীবনে সুখ চাইলে এদের এড়িয়ে চলুন