নিজস্ব প্রতিবেদক:
এক দশকেই রেলের বহর থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে ডেমু ট্রেন। বাংলাদেশ সরকার নিজস্ব অর্থায়নে ৬৫৪ কোটি টাকায় ডেমু ট্রেনগুলো কিনেছিল। চীনের তাঙসান রেলওয়ে ভেহিকল কোম্পানি লিমিটেডের কাছ থেকে ২০১৩ সালে কেনা এসব ট্রেনের আয়ু ধরা হয়েছিল ২০ বছর। কিন্তু নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় জনবল ও বিশেষায়িত কারখানা না থাকায় এক দশকের মধ্যেই রেলের বহর থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে ডেমু ট্রেন। এর আগে গত বছরের অক্টোবরে দেশীয় প্রযুক্তিতে মেরামত করা একটি ট্রেন বেশ ঢাকঢোল পিটিয়ে পুনরায় চালু করেছিল রেলওয়ে। কয়েক মাস চলার পর যান্ত্রিক ত্রুটিতে সেটিও বন্ধ হয়ে যায়। বাংলাদেশ রেলওয়ে সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বাংলাদেশ রেলওয়েতে এক বছর আগেও ছয় সেট ‘ডিজেল ইলেকট্রিক মাল্টিপল ইউনিট’ ট্রেন (ডেমু ট্রেন) সচল ছিল। এর মধ্যে রেলওয়ের ঢাকা বিভাগে দুটি, চট্টগ্রাম বিভাগে তিনটি ও লালমনিরহাট বিভাগে চলত একটি। তবে গত এক বছরে একে একে বিকল হয়েছে পাঁচ সেট ডেমু ট্রেন। বর্তমানে চট্টগ্রাম-নাজিরহাট রুটে একটি বাদে দেশের আর কোথাও কোনো ডেমু ট্রেন চলছে না। সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে করা বাংলাদেশ রেলওয়ের চুক্তি অনুযায়ী ট্রেনগুলো সরবরাহের পর ১৯ ধরনের প্রধান যন্ত্রাংশ, ৩৭ ধরনের সাধারণ যন্ত্রাংশ, ১৩৭ ধরনের রক্ষণাবেক্ষণ যন্ত্রাংশ ও ৩৭ ধরনের টুলস ও মেরামতকাজে ব্যবহৃত যন্ত্র দেয়ার কথা।
তবে অভিযোগ রয়েছে, প্রকল্প কর্মকর্তারা ওসব যন্ত্রের সবক’টি ঠিকভাবে বুঝে নেননি। ফলে কয়েক বছর চলার পর প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশের অভাবে নষ্ট হতে শুরু করে ট্রেনগুলো। কেনার পর ডেমু ট্রেনগুলো দিয়ে প্রায় এক কোটি যাত্রী পরিবহন করা হয়েছে। এতে আয় হয়েছে ২২ কোটি টাকার বেশি। যদিও ট্রেনগুলো মেরামত, রক্ষণাবেক্ষণ ও জ্বালানিতেই ব্যয় হয়েছে ৩০ কোটি টাকার বেশি।
সূত্র জানায়, ডেমু ট্রেন চালুর ছয় বছরের মধ্যে ইঞ্জিনে অস্বাভাবিক শব্দ, অতিরিক্ত কালো ধোঁয়া বের হওয়া, গরম হয়ে যাওয়া, লোডসহ নানা সমস্যা দেখা দেয়। তবে দীর্ঘ সময়েও রক্ষণাবেক্ষণ না করায় ট্রেনগুলো একে একে বিকল হয়ে গেছে। অথচ এগুলো কেনার সময় রেলওয়ের যুক্তি ছিল, ডেমু ট্রেনের দুদিকেই ইঞ্জিন থাকায় আলাদা ইঞ্জিনের দরকার হবে না। তাছাড়া বডি হালকা হওয়ায় জ্বালানিও লাগবে কম। সহজেই কম-বেশি করা যাবে গতি, ঝাঁকুনিও হবে কম। স্বল্প দূরত্বে ট্রেনগুলো পরিচালনা করে প্রচুর যাত্রী পরিবহন করা যাবে। যদিও বেশ কয়েকটি ডেমু ট্রেনকে স্বল্প দূরত্বের বদলে দূরপাল্লার রুটে পরিচালনা করে রেলওয়ে। বিকল হয়ে পড়ার পেছনে এটিও একটি কারণ।
কেনার পর নয়টি করে ডেমু ট্রেন চালু করা হয় ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিভাগে। যদিও ঢাকার সবক’টিই নষ্ট হয়ে পড়ে রয়েছে। চট্টগ্রাম বিভাগেও সচল রয়েছে কেবল একটি ট্রেন, যেটি চট্টগ্রাম-নাজিরহাট রুটে যাত্রী পরিবহন করছে। এর বাইরে লালমনিরহাট রেলওয়ে বিভাগে চালু করা দুটি ডেমু ট্রেনই এখন অকেজো হয়ে পড়ে রয়েছে। এর মধ্যে একটিকে গত বছর দেশীয় প্রযুক্তির মাধ্যমে সচল করতে সক্ষম হন রেলওয়ের প্রকৌশলীরা। ওই বছরের অক্টোবরে বেশ ঢাকঢোল পিটিয়ে ট্রেনটি উদ্বোধন করেন রেলপথমন্ত্রী। কয়েক মাস চলার পর সে ট্রেনটিও বন্ধ হয়ে যায়।
সূত্র আরো জানায়, বাংলাদেশ রেলওয়ে ডেমু ট্রেনগুলো একে একে বিকল হয়ে পড়ার বেশকিছু কারণ চিহ্নিত করেছে। ‘ডেমু ট্রেন মেরামত, রক্ষণাবেক্ষণ ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা’ শীর্ষক রেলওয়ের এক প্রতিবেদন উপস্থাপনায় বলা হয়, এসব ট্রেনে উচ্চপ্রযুক্তির সফটওয়্যারনির্ভর মডিউলসহ ইলেকট্রিক যন্ত্রাংশ ব্যবহার করা হয়েছে। তবে এ সম্পর্কে বাংলাদেশ রেলওয়ের কর্মীদের কোনো ধারণা ছিল না। এমনকি এসব মডিউল, যন্ত্রাংশ দেশের বাজারে পাওয়া যায় না। মূল নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে তা সংগ্রহ ও সফটওয়্যার প্রোগ্রাম করে ডেমুতে সংযোজন করার প্রয়োজন হয়, যা অত্যন্ত ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ। নষ্ট হয়ে গেলেও ইলেকট্রনিক এসব যন্ত্রাংশ বিশেষ করে মডিউলগুলো সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি।
একপর্যায়ে ডেমু ট্রেন রক্ষণাবেক্ষণ ও অপারেশন মারাত্মকভাবে বিঘিœত হয়ে পড়ে। তাছাড়া বাংলাদেশ রেলওয়ের ক্যারেজ, ওয়াগন, লোকোমোটিভ মেরামত ও শিডিউল রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ওয়ার্কশপ থাকলেও ডেমুর জন্য তা নেই। এসব ট্রেনের জন্য ওয়ার্কশপ নির্মাণের প্রস্তাব থাকলেও বাস্তবায়ন হয়নি। ফলে ট্রেনগুলো কেনার এক দশক হয়ে গেলেও ভারি কোনো শিডিউল রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়নি। এসব কারণে ডেমু ট্রেন অপারেশনে বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয় এবং অধিকাংশ সেট মেরামতহীন হয়ে পড়ে। রেলওয়ে কর্মকর্তারা অবশ্য আশা করছেন, রক্ষণাবেক্ষণের মাধ্যমে ডেমু ট্রেনগুলো আবার চালু করা সম্ভব।
এদিকে এ বিষয়ে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক কামরুল আহসান জানান, অচল অবস্থায় পড়ে থাকা ট্রেনগুলোর অবস্থা পর্যালোচনার জন্য আমরা এরইমধ্যে একটি কমিটি গঠন করে দিয়েছি। কমিটি গঠনের মূল উদ্দেশ্য হলো ট্রেনগুলোর বাস্তব অবস্থা যাচাই করে প্রয়োজনীয় রক্ষণাবেক্ষণের উদ্যোগ নেয়া। আমরা আশা করছি, দ্রুততম সময়ের মধ্যে কমিটির প্রতিবেদন হাতে পাব। এরপর প্রয়োজনীয় রক্ষণাবেক্ষণ করে ট্রেনগুলো দ্রুততম সময়ের মধ্যে চালু করতে সক্ষম হবো।
আরও পড়ুন
পাকিস্তান থেকে সরাসরি আসছে জাহাজ, আমদানি বেড়েছে ২১ শতাংশ
মিমো-নিলয়দের প্যাডসর্বস্ব দল হারালো বিমানবাহিনীকে
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণই সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ: পরিকল্পনা উপদেষ্টা