December 27, 2024

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Sunday, October 1st, 2023, 3:15 pm

কুলাউড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ৩৮ পদের বিপরীতে ১০ জন চিকিৎসক

জেলা প্রতিনিধি, মৌলভীবাজার:

মৌলভীবাজার জেলার মধ্যে কুলাউড়া উপজেলা একটি সর্ববৃহৎ উপজেলা। এই উপজেলার প্রায় পাঁচ লক্ষাধিক মানুষের একমাত্র ভরসাস্থল হলো উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে হাসপাতালে চিকিৎসক ও জনবল সংকট থাকার কারণে কোনমতে জোড়াতালি দিয়ে চলছে চিকিৎসা সেবা। হাসপাতালের চিকিৎসা সেবা এখন ভঙ্গুর পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছে। চিকিৎসক সংকটের কারণে হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা নিতে আসা রোগীরা নানা দূর্ভোগের শিকার হচ্ছেন। হাসপাতালে মঞ্জুরীকৃত ৩৮টি চিকিৎসক পদের বিপরীতে আছেন মাত্র ১০ জন। বাকি ২৮ পদ শূন্য।

চিকিৎসক সংকটের কারণে সাধারণ রোগীরা দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে কাঙ্খিত সেবা পেতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়। এদিকে হাসপাতালে মাত্র দুটি কক্ষে মেডিকেল অফিসাররা সাধারণ রোগী দেখছেন। যেসকল মেডিকেল অফিসার প্রতিদিন রাতে ডিউটি করেন তারা আবার পরেরদিন হাসপাতালে বর্হিঃবিভাগে সাধারণ রোগী দেখছেন। এতে মেডিকেল অফিসারদের দায়িত্ব পালনে নির্দিষ্ট সময়ের চেয়ে বেশি কর্ম ঘন্টা ব্যয় করতে হচ্ছে। চিকিৎসা নিতে আসা হাড় ভাঙ্গা জটিল রোগী ও সাধারণ রোগীর প্রাথমিক পরামর্শ হাসপাতালের জরুরী বিভাগ কিংবা বর্হিঃবিভাগে দায়িত্বরত মেডিকেল অফিসার দিচ্ছেন। এই রোগীদের শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে উন্নত পরামর্শের জন্য প্রয়োজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের। কিন্তু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হাসপাতালে না থেকে প্রেষণে অন্যত্র থাকায় উন্নত চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন রোগীরা। মেডিকেল অফিসাররা রোগীদের জেলা কিংবা বিভাগীয় শহরে উন্নত চিকিৎসার জন্য পরামর্শ দিচ্ছেন। এতে রোগী ও স্বজনদের আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে।

গত সোমবার হাসপাতালে জরুরী বিভাগে চিকিৎসা নেন বরমচাল ইউনিয়নের ইটাখলা গ্রামের বাসিন্দা রাহাদ মিয়ার স্ত্রী লিনা বেগম (২৩)। তিনি বিষপান করলে হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য মৌলভীবাজার সদর হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। পৃথিমপাশা ইউনিয়নের গনকিয়া গ্রামের বাসিন্দা মাসুক মিয়া ও মাছুমা বেগম নামের আরেক মেয়ে সম্প্রতি সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হলে তাদের মৌলভীবাজারে রেফার্ড করা হয়। কুলাউড়ার বিছরাকান্দি এলাকার বাসিন্দা জামাল মিয়া (৪০) ট্রেনের ধাক্কায় আহত হলে তাকে হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে সিলেট ওসমানী হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। এদিকে গত ৮ সেপ্টেম্বর জুড়ী উপজেলার বিশ্বনাথপুর গ্রামের বাসিন্দা আশরাফুল আলম (২৩) ঘুমের ওষুধ খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়লে তিনি হাসপাতালের জরুরী বিভাগে চিকিৎসা করাতে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৌলভীবাজারে রেফার্ড করেন।

বিভিন্ন সময় এই হাসপাতালে মেডিকেল অফিসার ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নিয়োগ দেয়া হলেও কিছুদিনের মধ্যেই তারা বদলি অথবা প্রেষণে অন্যত্র চলে যান। এই সংকটের কারণ হিসেবে জেলা কিংবা বিভাগীয় শহরে নিজেদের প্র্যাক্টিস ও উচ্চ শিক্ষা গ্রহণে সুযোগ এবং চিকিৎসকদের মফস্বলের প্রতি অনীহাই উল্লেখযোগ্য প্রধান কারণ বলে জানা গেছে।

সর্বশেষ উপজেলা হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা কমিটির মাসিক সভায় হাসপাতালের এ দুরবস্থার বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়। সভায় জরুরিভিত্তিতে সংকট নিরসনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টি কামনা করা হয়। সভায় কুলাউড়া হাসপাতালের সুচিকিৎসাসেবা প্রদানের স্বার্থে অনতিবিলম্বে প্রেষণের সকল পদের আদেশ বাতিল করে তাদের স্ব স্ব স্থানে বহাল এবং চিকিৎসক, ওটি রুম চালু, এক্সরে মেশিনের টেকনিশিয়ান ও অ্যাম্বুলেন্সের জ্বালানি সংকটের নিরসনে জরুরি পদক্ষেপ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্রে জানা গেছে, ৫০ শয্যা বিশিষ্ট এই হাসপাতালে মোট ৩৮টি পদের মধ্যে দুটি পদে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. ফেরদৌস আক্তার ও আবাসিক মেডিকেল অফিসার ভারপ্রাপ্ত (আরএমও) ডা. জাকির হোসেন দায়িত্বরত রয়েছেন। বাকী ৩৬ টি পদের মধ্যে ৫ জন মেডিকেল অফিসার ও কনসালটেন্ট ৫ জনের মধ্যে ২ জন কুলাউড়ায় কর্মরত আছেন। আর ইউনিয়ন উপ-স্বাস্থ্য কেন্দ্রে ১৭ পদের বিপরীতে ৫ জন মেডিকেল অফিসার কর্মরত আছেন। এছাড়া বিভিন্ন কর্মশালা, জেলা কিংবা উপজেলা সদরে বিভিন্ন মিটিংয়ে ইউএইচএফপিও ও আরএমও অংশগ্রহণ করেন।

প্রেষণে থাকা কনসালটেন্টদের মধ্যে জুনিয়র কনসালটেন্ট (মেডিসিন) ডাঃ এবিএম রেজাউল করিম মীর ২০১৫ সাল থেকে ও অর্থোপেডিক্স বিশেষজ্ঞ ডাঃ আব্দুল্লাহ আল মামুন ২০১৭ সাল থেকে নিজের স্বার্থের জন্য মৌলভীবাজার সদর হাসপাতালে কর্মরত আছেন। চর্ম ও যৌন রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. ইকবাল বাহার সপ্তাহে রবি ও বৃহস্পতিবার দায়িত্ব পালন করছেন কুলাউড়ায় আর বাকি ৪ দিন সিলেট শামছুদ্দিন হাসপাতালে। শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ আবু বকর নাসের রাশু হাসপাতালে দায়িত্ব পালন করছেন। গাইনী চিকিৎসক না থাকায় জুনিয়র কনসালটেন্ট (এনেস্থিসিয়া) ডা. আমিনুল ইসলাম গত ৭ মাস থেকে সিলেট শহীদ শামসুদ্দিন আহমদ হাসপাতালে দায়িত্ব পালন করছেন। মেডিকেল অফিসার ডাঃ তানজিলা রুম্মন মনু উপ-স্বাস্থ্য কেন্দ্রের দায়িত্বে থাকলেও করোনার সময় ২০২০ সালে তাকে ঢাকা মুগদা জেনারেল হাসপাতালে পদায়ন করেন স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ। অনুমোদিত অনুপস্থিত হিসেবে আইএমও ডা. নাজনিন সুলতানা প্রায় দুই বছর ধরে লন্ডনে রয়েছেন।

এছাড়া হাসপাতালের গাইনি, কার্ডিওলজী, চক্ষু, ইএনটি, ডেন্টাল সার্জন, এমও (আয়ূর্বেদিক), এমওসহ ২৮ ডাক্তারের পদ শূন্য রয়েছে। এদিকে ৫ জন পরিচ্ছন্নতাকর্মীর মধ্যে প্রেষণে ১ জন মৌলভীবাজার সদর হাসপাতালে ও ১ জন সিভিল সার্জন অফিসে কর্মরত আর দুই জন হাসপাতালে কর্মরত রয়েছেন। ফার্মাসিস্ট পদে ৭ জনের মধ্যে ২ জন, মেডিকেল টেকনোলজিস্ট (ল্যাব) ৩ জনের মধ্যে ২ জন, সেকমো ২ জনের মধ্যে ১ জন, অফিস সহায়ক ৯ পদের মধ্যে ৪ জন, নিরাপত্তা প্রহরী ২ জনের মধ্যে ১ জন, আয়া পদে ২ জনের মধ্যে ১ জন কর্মরত আছেন। ফিজিওথেরাপি বিভাগে মেডিকেল টেকনোলজিস্ট (ফিজিওথেরাপি) থাকার পরেও কোন যন্ত্রপাতি না থাকায় তিনি ২০১০ সাল থেকে বেকার অফিস করছেন। দ্রুত গতিতে চিকিৎসক সংকট ও সমস্যা সমাধানের জন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের প্রেষণ আদেশ বাতিল ও নতুন চিকিৎসক নিয়োগের দাবী জানান ভুক্তভোগীসহ কুলাউড়ার সচেতনমহল।

উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. ফেরদৌস আক্তার বলেন, চিকিৎসক ও লোকবল সংকটে বিভিন্ন সমস্যায় পড়তে হয়। তবুও সর্বোচ্চ চেষ্টা দিয়ে আমরা চিকিৎসা সেবা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। চিকিৎসক সংকটের বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে একাধিকবার। প্রেষণে চিকিৎসকরা অন্যত্র চলে যাবার বিষয়ে তিনি বলেন, জেলা সদরসহ বিভাগীয় হাসপাতালগুলোতে বিশেষজ্ঞ পদ শূন্য থাকায় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা প্রেষণে সেখানে দায়িত্ব পালন করছেন।

মৌলভীবাজার জেলা সিভিল সার্জন ডা. চৌধুরী জালাল উদ্দিন মুর্শেদ বলেন, চিকিৎসক ও জনবল সংকট সমাধানে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে। নতুন বিসিএস থেকে যারা উত্তীর্ণ হবে তাদের মধ্যে থেকে কুলাউড়ায় চিকিৎসক নিয়োগ দেয়া হবে। প্রেষণে থাকা চিকিৎসকদের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালকের আদেশে তারা প্রেষণে রয়েছেন। প্রেষণ আদেশ বাতিলের জন্য আমার কার্যালয় থেকে কয়েকবার চিঠিও দিয়েছি। কিন্তু এখনো কোন উত্তর পাইনি।

সিলেট বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডাঃ শরীফুল হাসান বলেন, সিলেটে নতুন যোগদান করে জেনেছি বিভিন্ন উপজেলার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা প্রেষণে রয়েছেন। তাদের সেই প্রেষণ আদেশ বাতিলের জন্য কাজ করে যাচ্ছি। তিনি আরো বলেন, প্রথমে কুলাউড়া হাসপাতালের ওটি রুম চালু করার উদ্যোগ নিতে হবে। তারপর প্রেষণে থাকা চিকিৎসকদের আদেশ বাতিল করে জেলা সিভিল সার্জনের সাথে আলোচনা করে তাদের উপজেলায় পুনরায় পদায়ন করা হবে। তবে জনবল ঘাটতি ও এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি না থাকার কারণে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা প্রেষণে চলে যান অন্যত্র।