সৈয়দ তোশারফ আলী
ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন চির নিদ্রায় শায়িত। ঢাকার আজিমপুর কবরস্থানে মাতা- পিতার কবরের পাশে তিনি ঘুমিয়ে আছেন। তার কাছ থেকে উপদেশ- নির্দেশ, পরামর্শ গ্রহণের সুযোগ আর নেই। তবে তার চিন্তাধারা, জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য,এক কথায় তার জীবনদর্শন আমাদের সবারই কমবেশি পরিস্কারভাবে জানা আছে। তিনি ছিলেন নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে বিশ্বাসী । সংসদীয় পদ্ধতির গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থাকে তিনি এদেশের জন্য উপযুক্ত মনে করতেন। তিনি সাহসী ছিলেন, আদর্শের প্রশ্নে অটল ছিলেন কিন্তু বিপ্লবী ছিলেন না।
বাক স্বাধীনতাকে তিনি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে মনে করতেন। সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে তিনি বাক স্বাধীনতার অংশ হিসেবেই দেখতেন। ব্যক্তি স্বাধীনতা ও মৌলিক মানবাধিকার সুরক্ষায় স্বাধীন বিচার ব্যবস্থাকে তিনি গণতন্ত্রের শক্তিশালী স্তম্ভ বিবেচনা করতেন। আইনের শাসন ও ভিন্ন মতের প্রতি সহিষ্ণুতা ছাড়া যে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা বিকশিত করা যায় না,একথা তিনি তার লেখায় ও বক্তৃতায় বার বার উল্লেখ করেছেন। কিন্তু গণতন্ত্র যে ধনতান্ত্রিক অর্থনীতির রাজনৈতিক ব্যবস্থা এবং অবিকশিত ধনতান্ত্রিক অর্থনীতিতে বা বনিক পুঁজির আধিপত্য ও সামন্ত- বাদী মন-মানসিকতা যেখানে প্রবল সেখানে টেকসই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা যে দুরূহ , এমনকি অসম্ভব —এই বিশ্লেষণে তিনি কখনো যাননি। পাকিস্তানের রাজনীতিতে গণতন্ত্র যে দৃঢ়মূল হতে পারেনি তার অন্যতম কারণ সামন্তবাদী অর্থনীতি ও মন-মানসিকতার প্রভাব। যে কারনে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মতো বিচক্ষণ রাজনৈতিক নেতাও গণতন্ত্রের অভিযাত্রাকে সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যেতে পারেন নি। পাকিস্তানের বহুল আলোচিত ২২ পরিবার যে শিল্পভিত্তিক অর্থনীতি গড়ে তোলার লক্ষ্যে অবদান রাখতে শুরু করেছিল তার বিরোধিতায় সোচ্চার ছিল কৃষক গণতন্ত্রী মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, যিনি কাগমারী সম্মেলনে আওয়ামী লীগের ভাঙনে নেতৃত্বের ভূমিকা রেখেছিলেন। যা পাকিস্তানে সামরিক শাসন আসার পথ করে দেয়। জেনারেল আইয়ুব খানের সহযোগী হিসেবে লারকানার জমিদার জুলফিকার আলী ভুট্টোর প্রথম দিকের ভূমিকা এবং পরবর্তীতে তার বিরোধিতায় অগ্রনী ভূমিকা পালনের আর্থিক কার্যকারণ বিশ্লেষণ করলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। বস্তুত, শিল্পভিত্তিক ধনতান্ত্রিক অর্থনীতি গড়ে উঠলে অবশ্যই তার উপযোগী গনতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা সুদৃঢ় হতো। কিন্তু সে পথে আমরা হাঁটিনি। ক্ষুদ্রায়তনী অর্থনীতি থেকে উদ্ভূত জাতীয়তাবাদী আবেগ আমাদের যুক্তিবাদী হতে দেয়নি। আমরা”বাহির পানে তাকিয়েছি” কিন্তু “ভেতর পানে চাইনি”। সাম্রাজ্যবাদকে ধিক্কার দিয়েছি কিন্তু নিজেদের ভুল ধরতে পারিনি। মইনুল হোসেন তার বিশ্লেষণে ব্যাক্তির ভূমিকাকে অধিকতর গুরুত্ব দিয়েছেন আর্থ- সামাজিক পটভূমি বিশ্লেষণে তেমন আগ্রহ দেখাননি। ব্যস্ততার কারণে সে সময়ও তিনি পাননি।
জীবনের একাধিক ক্ষেত্রে তিনি পদচারণা করেছেন। তবে তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন আইনজীবী ও রাজনৈতিক নেতা হবার। যেমনটি ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাকে তার পিতার মৃত্যুর পর পারিবারিক শুভাকাঙ্ক্ষীদের অনুরোধে দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার সম্পাদক পদের দায়িত্ব নিতে হয়। তরুণ বয়সে তিনি তার পিতার কলকাতা জীবনের সঙ্গী ছিলেন। ঢাকায় সংবাদপত্রসেবী পিতার কাজে সাহায্য সহযোগিতাও করেছেন। কিন্তু কখনও সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালনের কথা তার চিন্তার দিগন্তে ছিল না। কিন্তু নিয়তি তাকে সেই গুরু দায়িত্ব পালনের পথে ঠেলে দেয়। কিন্তু সেই দায়িত্ব পালনে তিনি যে নিষ্ঠার পরিচয় দেন তা থেকে সাংবাদিক মাত্রেই শিক্ষা নিতে পারেন।
এ প্রসঙ্গে বলতে হয়, ইত্তেফাক বলতে পাঠকরা বুঝাতো মুসাফিরের “রাজনৈতিক মঞ্চ”। তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া মুসাফির ছদ্ম নামে এই “রাজনৈতিক মঞ্চ” লিখতেন। অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল তার এই কলাম। এ কালামের কোন জুড়ি ছিল না। বিকল্প ভাবতে গিয়ে তিনি বিখ্যাত লেখক আবুল মনসুর আহমদের স্মরনাপনন হন । তাকে লিখতে রাজী করান। অন্য লেখক সাহিত্যিকরাও এ ব্যাপারে তাকে সাহায্য করেন। চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে তিনি নিজে তিন বেলা সকাল, বিকাল ও রাতে অফিসে করতেন। বিলেত থেকে ব্যারিস্টার হয়ে এসে তিনি যখন আইনজীবী হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলবেন ঠিক সেই সময়ে পিতার রেখে যাওয়া প্রতিষ্ঠানের ঐতিহ্য সমুন্নত রাখার জন্য তিনি যে শ্রম ও মেধা দেন তার সুবাদে ইত্তেফাক সংকট কাটিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়। কিন্তু আবার একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে পাক বাহিনী আগুন দিয়ে ভস্মিভূত করে দেয় স্বাধীন চিন্তার সূতিকাগার দৈনিক ইত্তেফাক।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জন করার পর সেই ছাইয়ের স্তূপের উপর নতুন করে যাত্রা শুরু করে ইত্তেফাক । গণতন্ত্রের পথে বাংলাদেশের নবযাত্রা শুরু হচ্ছে দেখে মইনুল হোসেন ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে ভান্ডারিয়া থেকে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তখন অনুজ আনোয়ার হোসেন মঞ্জুকে ইত্তেফাকের সম্পাদক করেন এবং নিজে সম্পাদক মন্ডলীর সভাপতি হন। কিন্তু আর্থ -সমাজিক অস্থিরতার মধ্যে গণতান্ত্রিক জীবনধারা মশৃনভাবে এগিয়ে নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। শিল্প কারখানায় লোকসানের মহামারী শুরু হয়। চোরাচালানি আর কালোবাজারি অর্থনীতির বারোটা বাজিয়ে দেয় ।আইন শৃংখলার অবনতি মানুষের রাতের ঘুম কেড়ে নেয়। গণতান্ত্রিক শাসন পদ্ধতি থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় বাংলাদেশ। আবার নতুন করে আঘাত আসে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার উপর। সরকারী মালিকানায় ইত্তেফাক সহ ৪টি দৈনিক রেখে প্রায় সকল পত্রপত্রিকার ডিক্লারেশন বাতিল করে দেওয়া হয়। এজন্য সংবাদ পাত্রের ইতিহাসে ১৬ই জুন কালো দিবস হিসেবে পালিত হয়। মইনুল হোসেনের ব্যক্তিত্বকে উপলব্ধি করতে হলে এ প্রাসঙ্গিক পটভূমিকে সামনে রাখতে হবে। আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রের পথ পরিহার করে একদলীয় কর্তৃত্ববাদী শাসন প্রতিষ্ঠার দিকে ঝুঁকলে শুধু ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনের জন্য নয়, আরও অনেক সংসদ সদস্যের জন্য আদর্শিক
সংকট সৃষ্টি হয়। কিন্তু সবাই সাহস দেখাতে পারে না। মুক্তিযুদ্ধের অধিনায়ক এম এ জি ওসমানী এবং ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন ,এই দুজন সংসদ সদস্য ছিলেন ব্যতিক্রম। তারা সংসদ থেকে পদত্যাগ করেন এবং আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। এই ঘটনা তাদের আদর্শ নিষ্ঠা ও চারিত্রিক দৃঢ়তার স্বাক্ষর বহন করে।
এরপর রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে অনেক উত্থান পতনের ঘটনা ঘটেছে। পরিবর্তিত পটভূমিতে মইনুল হোসেন দলীয় রাজনীতিতে আর তেমন সুবিধা করতে পারেননি। পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে তিনি রাজনৈতিক নিবন্ধ লিখে রাজনীতিকে গণতান্ত্রিক ধারায় রাখতে চেষ্টা করে গেছেন। কিছু দিনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হয়ে গণতন্ত্রের সাফল্য দেখতে চেয়েছিলেন কিন্তু দেশে তিনি এমন এক কর্তৃত্ববাদী শাসন দেখতে পান, যা প্রত্যক্ষ উপনিবেশেও দেখা যায় না । স্বপ্ন ভঙ্গের বেদনা নিয়ে তিনি এই ধরাধাম থেকে বিদায় নিয়েছেন। আফসোস তিনি স্বৈরশাসনের পতন দেখে যেতে পারেননি। তবে রেখে গেছেন তার জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতার গল্প।যা থেকে প্রেরণা পাবে নতুন প্রজন্ম। *
মুক্তিযোদ্ধা, সাহিত্যিক ও ইংরেজি দৈনিক নিউ নেশন পত্রিকার উপদেষ্টা সম্পাদক।

আরও পড়ুন
জাতীয় সাংবাদিক সংস্থা কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনের দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী পালিত
নির্বাচনের ট্রেনে আমরা উঠে গেছি: সিইসি
শোক ও শ্রদ্ধায় ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনের দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী পালিত