নিজস্ব প্রতিবেদক:
সরকারের সুদজনিত ব্যয় বাড়ছে। বিগত ৫ বছরে তা বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। আর সঞ্চয় কর্মসূচির বিপরীতে ওই ব্যয় বেড়ে ৩ গুণ হয়েছে। ভবিষ্যতে তা আরো বাড়বে। সঞ্চয়পত্র থেকে গত অর্থবছরে (২০২০-২১) সরকার আগের অর্থবছরের চেয়ে ৩ গুণ বেশি ঋণ নিয়েছে। মূলত ব্যাংকগুলোতে আমানতের বিপরীতে সুদের হার কমানোর কারণে গ্রাহকরা প্রয়োজন মেটাতে সঞ্চয়পত্র কিনেছে। আর সঞ্চয়পত্রের বিক্রি আগের তুলনায় বেড়ে যাওয়ায় সরকারের ঋণের বোঝা বাড়ছে। আর সঞ্চয়পত্রের মুনাফা দিতে গিয়ে সরকারের সুদ ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। যার কারণে দেশের অর্থনীতিতে ভারসাম্যহীনতা তৈরি হচ্ছে। অর্থনীতিতে এমন চাপ কমাতে সঞ্চয় কর্মসূচিতে অতিমাত্রায় বিনিয়োগ এবং বিনিয়োগের ক্রমবর্ধমান উর্ধগতি রোধ করতে সুদহার কমানো হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, অবসরপ্রাপ্ত কর্মকতা-কর্মচারী, গ্রামাঞ্চলের বিভিন্ন বয়সের মানুষের কাছে ঝুঁকিহীন বিনিয়োগ হিসেবে সঞ্চয়পত্রের বেশ কদর রয়েছে। সরকার গত অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকে নিট প্রায় ৪২ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে, যা আগের অর্থবছরে ছিল ১৪ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা। জাতীয় সঞ্চয় অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী ২০২০-২১ অর্থবছরে ১ লাখ ১২ হাজার কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। তার আগে কোন বছরে এতো বেশি সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়নি। এমন পরিস্থিতিতে অর্থনীতিতে ভারসাম্য ফেরাতে সঞ্চয়পত্রে সুদের হার কমানো ছাড়া বিকল্প নেই। মূলত ব্যাংকের সুদের হার কমায় গ্রাহকরা সঞ্চয়পত্রে ঝুঁকেছিল। এখন ওই গ্রাহকদের সঞ্চয়পত্রে অনাগ্রহী করার চেষ্টা চলছে। সরকারের ঋণের বোঝা কমানোর অংশ হিসেবে সঞ্চয়পত্রের নতুন সুদহার ঘোষণা করা হয়েছে। তাতে সঞ্চয়পত্রের সুদের ওপর নির্ভরশীল গ্রাহকের ওপর চাপ বাড়বে। তারা সঞ্চয়পত্রের বিপরীতে অধিক মুনাফার জন্য পুঁজিবাজারে ঝুঁকি নিয়ে বিনিয়োগ করবে। যদিও ব্যাংকের সুদের হার সর্বনিম্ন পর্যায়ে আসা ও সঞ্চয়পত্রের সুদের নতুন হারের কারণে পুুঁজিবাজারে বুদ্ বুদ্ তৈরির আশঙ্কা রয়েছে। তাতে বাড়বে বিনিয়োগ ঝুঁকির শঙ্কাও।
সূত্র জানায়, বর্তমানে ব্যাংক আমানতের সুদের হার সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমেছে। কয়েকদিন আগে অধিকাংশ ব্যাংকের মেয়াদী আমানতে মূল্যস্ফীতির হারের চেয়ে কম হারে সুদ দেয়া হচ্ছিল। ফলে সুদের ওপর নির্ভরশীল ব্যক্তিরা ব্যাংক থেকে টাকা উত্তোলন করে সঞ্চয়পত্র কিনেছে। করোনাকালে দেশে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ বিবিধ খাতে মন্দাবস্থার কারণে ব্যাংকগুলোতে উদ্বৃত্ত তারল্য দেখা দেয়। আর সঞ্চয়পত্র বিক্রির পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় মুনাফা দিতে গিয়ে সরকারের সুদ ব্যয় বেড়ে যাচ্ছিল। ফলে অর্থনীতিতে তৈরি ভারসাম্যহীনতা হচ্ছিল। এমন বাস্তবতায় অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষায় সরকার সঞ্চয়পত্রের মুনাফায় হাত দিয়েছে।
সূত্র আরো জানায়, সঞ্চয়পত্রে গ্রাহকদের আগ্রহ বাড়লেও উল্টো দিকে সমানহারে ব্যাংকগুলোতে আমানতের সুদহার তলানিতে নেমেছে। এমনিতেই করোনাকালে বিনিয়োগ কমেছে এবং ব্যাংকগুলোতে নগদ টাকার পাহাড় জমছে। কিন্তু ওই তুলনায় ব্যাংক ঋণের হার কমেছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে বেশ কিছু ব্যাংক তার গ্রাহকদের মূল্যস্ফীতির হারের চেয়েও কম সুদ দিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে গত আগস্ট মাসে আমানতের সর্বনিম্ন সুদহার বেঁধে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে ব্যাংকের ৩ মাস ও তার বেশি মেয়াদী আমানতের সুদ হার কোনভাবেই মূল্যস্ফীতির চেয়ে কম হবে না। কিন্তু তাতে গ্রাহকদের আগ্রহ বাড়েনি।
এদিকে অর্থনীতিবিদদের মতে, সঞ্চয়পত্র বেশি বিক্রি হওয়ার কারণে সরকারের ওপর দায় বাড়ছে। সেজন্য সরকার গত কয়েক বছর ধরেই সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমানোর জন্য নানা শর্তজুড়ে দিয়েছে। সরকার বিক্রি কমানোর জন্য ২ লাখ টাকার ওপর সঞ্চয়পত্র বিক্রির ক্ষেত্রে টিআইএএন বাধ্যতামূলক করে দেয়। কিন্তু এতেও সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমেনি, উল্টো বেড়েছে। সরকারের নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এক রকম হার, আর ৩০ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আলাদা রকম হার এবং ৩০ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আরেক রকম হার করা হয়েছে। তবে ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগের ক্ষেত্রে মুনাফার হার আগের মতোই আছে। প্রান্তিক ও নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষের কথা চিন্তা করে সরকার ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত সুদহারে কোন হাত দেয়নি। মূলত দেশের সুষ্ঠু অর্থনীতির ভারসাম্য বজায় রাখার স্বার্থেই সরকার এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার কমানো হলেও প্রান্তিক বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ বিবেচনা করা হয়েছে।
অন্যদিকে সঞ্চয়পত্রে সুদহার কমানোর ফলে পুঁজিবাজারে টাকার প্রবাহ বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। পুঁজিবাজারে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে বর্তমানে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের প্রতিনিধি দল সুইজারল্যান্ডে রয়েছে। সেখানে বিদেশী বিনিয়োগ টানতে রোড শো অনুষ্ঠিত হয়েছে। তার আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও দুবাইয়ে রোড শো অনুষ্ঠিত হবে। আগামীতে যুক্তরাজ্য, কানাডাসহ বিভিন্ন দেশে রোড শো অনুষ্ঠিত হবে। সেখানে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের জন্য আহ্বান জানানো হবে। সঞ্চয়পত্রের টাকা পুঁজিবাজারকে আরো গতিশীল করবে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান ড. শিবলী রুবাইয়াত উল ইসলাম জানান, বর্তমানে পুঁজিবাজারের সূচক যেখানে অবস্থান করছে, সেখানে কোন বিনিয়োগ ঝুঁকি নেই। কারণ বাজার এখনো অতিমূল্যায়িত হয়নি। এখনো বাজারে বিনিয়োগ করা যায়।
আরও পড়ুন
পাঁচ বছর বিরতির পর জাহাজ রপ্তানিতে ফিরলো ওয়েস্টার্ন মেরিন
ইসলামে ঐক্যের গুরুত্ব
দিনে কতক্ষণ স্মার্টফোন ব্যবহার করা উচিত?