December 30, 2024

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Thursday, April 27th, 2023, 7:26 pm

ঘেরে চিংড়ি মারা যাওয়ায় হতাশ খুলনার চাষীরা

দক্ষিণাঞ্চলের আয়ের অন্যতম উৎস সাদা সোনা খ্যাত চিংড়ি চাষ। খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাটের অধিকাংশ মানুষ চিংড়ি চাষের উপর নির্ভরশীল। তবে বিক্রি উপযোগীর পূর্ব মূহুর্তে মারা যাচ্ছে ঘেরের চিংড়ি। উৎপাদন মৌসুমের শুরুতেই পুঁজি হারিয়ে আর্থিক বিপর্যয়ে পড়েছেন চাষিরা। ঋণগ্রস্ত হয়ে ঘের ফেলে রেখে জীবিকার উদ্দেশে অন্যত্র পাড়ি জমাচ্ছেন অনেকে।

মৎস্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জৈব নিরাপত্তা নিশ্চিত না করা, ঘেরের গভীরতা সংকট, পানির উৎসের সমস্যা, অক্সিজেন স্বল্পতা ও খাদ্য সংকটের পাশাপাশি অতিরিক্ত গরমে চিংড়ি মারা যাচ্ছে।

চিংড়ি চাষীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এ বছর উৎপাদনের শুরুতেই অধিকাংশ ঘেরের চিংড়ি মাছ মারা গেছে। মৎস্য কর্মকর্তাদের পরামর্শে বিভিন্ন কিছু ব্যবহার করলেও চিংড়ি মৃত্যু বন্ধ হচ্ছে না। প্রথম দফার পূঁজি হারিয়ে ঋণ করে পরবর্তীতে চুনসহ আনুষঙ্গিক দ্রব্য প্রয়োগ করে পোনা ছাড়লেও ঘেরের পরিবেশ তেমন ভালো অবস্থায় নেই। সেই মাছও মারা যাচ্ছে অনেকের। ঘেরে বিনিয়োগ করা মূলধন হারিয়ে দিশেহারা তারা। এর সঙ্গে রয়েছে ব্যাংক ও এনজিও থেকে ঋণ পরিশোধের তাড়া। ক্ষতিগ্রস্ত চাষিরা চরম মানবেতর জীবন-যাপন করছেন। অনেকে চরম আর্থিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়ে জীবিকার উদ্দেশে এলাকা ছাড়ছেন। বিগত কয়েক বছর যাবৎ ৩৫ থেকে ৪৫ দিন বয়সের চিংড়ি মারা যাচ্ছে। বিক্রি উপযোগী হওয়ার পূর্ব মুহুর্তে বাগদা মারা যাওয়ায় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন তারা। এতে বিনিয়োগের পাশাপাশি উৎপাদনের সময়ও নষ্ট হচ্ছে। এছাড়া যে ঘেরে একবার মাছ মারা যায় তার পরিবেশ অনুকূলে থাকে না। ছোট পোনাও মারা যায়। একবার মাছ মরা ধরলে স্বাভাবিক হতে বেশ কয়েক মাস সময় লাগে।

চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে জানা যায়, মাঘ মাসের শেষের দিকে দক্ষিণাঞ্চলে ঘের প্রস্তুতির পর পোনা ছাড়া শুরু হয়। পানি উত্তোলনে সমস্যার কারণে অনেকে ফাল্গুন মাসের মাঝামাঝিতে পোনা ছাড়ে। আর এসব পোনা বিক্রির উপযোগী হতে দুই থেকে তিন মাস লাগে। সাধারণত দুই মাস পরে প্রতিটি ১৫-২০ গ্রাম ওজনের হয়। আর তিন মাস পরে ৩০-৩৫ গ্রাম ওজনের হয়। বাগদা মারা যাওয়ার শঙ্কায় বর্তমানে অধিকাংশ চাষি দুই মাসের আগেই মাছ ধরা শুরু করে। প্রথম দফা পোনা ছাড়ার পর থেকে প্রতি মাসে বিঘা প্রতি দুই থেকে তিন হাজার পোনা ছাড়া হয়। আর মাছ ধরা শুরুর পর থেকে প্রতি গোণে কিছু কিছু মাছ ধরা হয়। এভাবে অগ্রহায়ণ মাস পর্যন্ত বাগদার চাষ করা হয়। ঘেরে ব্যবহার করা হয় চুন, সার, জিওলাইট, চিটাগুড়, অটো পালিস। অধিকাংশ ঘেরের পানির গভীরতা দেড় থেকে দুই ফুট। জৈব নিরাপত্তা নেই আর শ্যাওলায় ভরা। প্রায় ৯৫ শতাংশ ঘেরে এই পদ্ধতিতে বাগদা চাষ করা হয়। এটিকে সনাতন পদ্ধতি বলা হয়।
খুলনার কয়রা উপজেলার দেয়াড়া গ্রামের চিংড়ি চাষি তৈয়েবুর রহমান বলেন, তিন বিঘা জমিতে চিংড়ি চাষ করি। পোনা ছাড়ার ৩৭ দিন পর মাছ মরা শুরু করে। আশা করেছিলাম ৫০-৫৫ দিন পর ৬০ থেকে ৭০ পিস এ কেজি হলে বাগদা ধরা (বিক্রি) শুরু করবো।

তিনি আরও বলেন, গত বছর উৎপাদন খরচ তুলতে পারিনি। এ বছর শুরুতেই ক্ষতির মুখে পড়ে সংসার চালাতে হিমসিম খাচ্ছি।

একই এলাকার চিংড়ি চাষী আব্দুল হাই বলেন, নিজেদের ৫ বিঘা জমিতে বাগদা চাষ করি। সেই আয় দিয়ে সংসার চালাতে হয়। এক মাস ১০ দিন পর মাছ মরা শুরু হয়। ঘেরে ফের পোনা ও চুন-খাবার দেই। সেই ছোট পোনাও বড় বাগদার সাথে মরা পাচ্ছি। ঋণ করে সংসার চালাচ্ছি। বাধ্য হয়ে ঘের ফেলে রেখে বাইরে কাজে যাচ্ছি।

সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার আবু দাউদ জানান, তাদের এলাকার অধিকাংশ ঘেরের চিংড়ি ৩৫ থেকে ৪৫ দিন বয়সে মারা যাচ্ছে। অনেকে ছোট থাকতে বাগদা বিক্রি শুরু করে কোন রকমে পোনা ছাড়ার টাকা তুলতে পেরেছে। তবে কিছু ঘের ভালো রয়েছে।

বাগেরহাট জেলার মোংলা উপজেলা মৎস্য চাষী সমিতির সভাপতি বিদ্যুৎ মন্ডল বলেন, বর্তমানে বড় সমস্যা ৩৫ থেকে ৪৫ দিন বয়সের বাগদা মারা যাচ্ছে। এবছর অধিকাংশ ঘেরের প্রথম দফার চিংড়ি দেড় ইঞ্চি সাইজের হওয়ার পরে মারা গেছে। এখন কিছুটা ভালো থাকলেও মরা বন্ধ হয়নি। একবার কোন ঘেরে বাগদা মরা শুরু করলে পাশ্ববর্তী ঘেরগুলোও আক্রান্ত হয়। আর ঘেরের পরিবেশ ঠিক করতে প্রায় দুই থেকে তিন মাস লাগে। তবে দ্বিতীয়বার মারা গেলে চাষির ক্ষতির অন্ত থাকেনা।

জেলা মৎস্য অফিস সূত্রে, খুলনা জেলায় ২০ হাজার ৪৩০ টি বাগদা চাষের ঘের রয়েছে। যার মোট আয়তন ৩২ হাজার ৯৯৮ হেক্টর। সাতক্ষীরা জেলায় ৬৬ হাজার ৫৯৭টি বাগদা চাষের ঘের রয়েছে। যার মোট আয়তন ৭৮ হাজার ২৪০ হেক্টর।

খুলনার কয়রার সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. আমিনুর হক বলেন, সম্প্রতি কোথাও কোথাও ইএমএস (আর্লি মর্টালিটি সিনড্রম) দেখা দিচ্ছে। এর ফ‌লে ৪০ থেকে ৪৫ দিনের মধ্যে মাছ মারা যায়। ভিব্রিও প্যারাহিমোলাইটিক্যাস ও ভিব্রিও হার্বি নামক ব্যাকটেরিয়ার কারণে এটি দেখা দেয়। এছাড়া তাপমাত্রা বৃ‌দ্ধির কার‌ণেও সমস‌্যা হ‌চ্ছে। দ্রুত প্রতিরোধে ঘেরের জৈব নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চারপাশে নেট ব্যবহার করতে হবে। সব সময় ৩ থেকে ৫ ফুট পানি ধরে রাখতে অবশ্যই গভীরতা বাড়াতে হবে। এছাড়া ভাইরাসমুক্ত পিসিএফ পোনা ছাড়ার পাশাপাশি গুড এ্যাকোয়া কালচার পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে।

সাতক্ষীরা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. আনিছুর রহমান বলেন, ঘেরগুলোতে পানির গভীরতা না থাকায় অতিরিক্ত গরমে পানি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। অক্সিজেন ঘাটতি হচ্ছে। এছাড়া ঘেরগুলোর ম্যানেজমেন্ট চিংড়ি চাষের উপযোগী নয়। চিংড়ি চাষীদের করণীয় সম্পর্কে আমাদের পরামর্শ প্রদান অব্যাহত রয়েছে।

তবে ভাইরাস কিংবা ব্যাকটেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে কিনা এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, স্যাম্পল টেষ্ট করা হয়নি। পরীক্ষা না করে বলা সম্ভব হবে না।

খুলনা জেলা মৎস‌্য কর্মকর্তা জয়‌দেব পাল ব‌লেন, ল‌্যা‌বে নমুনা পাঠা‌নো হ‌য়ে‌ছে। রি‌পোর্ট না পাওয়া পর্যন্ত প্রকৃত কারণ বলা যা‌বে না। ত‌বে অ‌তি‌রিক্ত গর‌মে প‌রি‌বেশগত সমস‌্যায় বাগদা মারা যা‌চ্ছে। এছাড়া রো‌গেও মারা যেতে পা‌রে। এ‌ক্ষে‌ত্রে গভ‌ীরতা বাড়া‌নোর বিকল্প নেই।

—-ইউএনবি