অনলাইন ডেস্ক:
প্রধান বিচারপতিসহ অন্যান্য বিচারকদের অবসরের বয়স ৭০ বছর করার প্রস্তাব করেছে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন। এজন্য বিদ্যমান সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ সংশোধনের প্রস্তাব করা হয়েছে। বিদ্যমান সংবিধানে প্রধান বিচারপতি এবং সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের অবসরের বয়স ৬৭ বছর নির্ধারণ করা রয়েছে। এই অবসরের বয়সসীমা তিন বছর বৃদ্ধি করে ৭০ করার প্রস্তাব করল কমিশন।
এছাড়া মামলা জট নিরসনে স্বল্পমেয়াদি ব্যবস্থা হিসেবে অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজদের মধ্যে যারা সৎ, দক্ষ ও সুস্বাস্থ্যের অধিকারী তাদের দুই-তিন বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়ারও প্রস্তাব করা হয়েছে। কমিশন বলছে, অধিক সংখ্যক ফৌজদারি আপিল ও রিভিশন, দেওয়ানি আপিল ও রিভিশন নিষ্পন্নাধীন রয়েছে এরূপ জেলাসমূহে অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজদের নিয়োগ করা যেতে পারে। দীর্ঘমেয়াদি ব্যবস্থা হিসেবে বিচার প্রক্রিয়া এবং এর সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বিশেষত বিচারক, ফৌজদারি মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এবং প্রসিকিউটর এবং বিচারাঙ্গনকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করতে হবে। এছাড়া সুপ্রিম কোর্টের প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ, বিচার বিভাগের কার্যক্রমে গতিশীলতা আনতে স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস গঠন, বিচার বিভাগের যথাযথ বিকেন্দ্রীকরণ করা, স্বতন্ত্র ফৌজদারি তদন্ত সংস্থা গঠনের প্রস্তাব করেছে কমিশন। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে এই সুপারিশ সংক্রান্ত খসড়া প্রতিবেদন বুধবার হস্তান্তর করেন বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের প্রধান আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মোমিনুর রহমান ও কমিশনের সদস্যরা। পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন দিতে আগামী ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত সময় বাড়িয়েছে সরকার।
খসড়া সারসংক্ষেপে কমিশন বলছে, বিচার বিভাগকে দুর্নীতিমুক্ত রাখতে প্রতি তিন বছর পরপর সুপ্রিম কোর্ট এবং অধস্তন আদালতের বিচারকদের সম্পত্তির বিবরণ সুপ্রিম কোর্টে প্রেরণ এবং তা ওয়েবসাইটের মাধ্যমে জনসাধারণের কাছে প্রকাশ করতে হবে। ওয়েবসাইটে প্রকাশ করতে হবে সুপ্রিম কোর্ট ও অধস্তন আদালতের সহায়ক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্পত্তির বিবরণীও। নিম্ন আদালতের বিচারকদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তের জন্য সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের সমন্বয়ে তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি প্রাথমিক তদন্ত কমিটি গঠন করতে হবে। তদন্তে অভিযুক্ত বিচারকের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা বা অন্যবিধ ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা প্রদান করারও সুপারিশ করা হয়েছে। এছাড়া গ্রাম পর্যায়ে ছোট ছোট বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য স্থানীয়ভাবে কার্যকর বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি পদ্ধতি প্রবর্তন জরুরি। প্রয়োজনে লিগ্যাল এইড কার্যক্রমের সহায়তা গ্রহণ করতে হবে। বর্তমানে চালু থাকা গ্রাম আদালতের আমূল সংস্কারের মাধ্যমে বিচারকে মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।
গত ৩ অক্টোবর গেজেট জারির মাধ্যমে আট সদস্যবিশিষ্ট বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন গঠন করে দেয় সরকার। বিচার বিভাগকে স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও কার্যকর করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সংস্কার প্রস্তাব করার দায়িত্ব দেওয়া হয় কমিশনকে। কমিশন নিয়মিত সভা করার পাশাপাশি দেশি-বিদেশি অংশীজন, আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি এবং অন্যান্য সংস্কার কমিশনের সঙ্গেও মতবিনিময় করে। ওয়েবসাইটের মাধ্যমে সাধারণ নাগরিক, আইনজীবী, বিচারক ও আদালতের সহায়ক কর্মচারীদের মতামত সংগ্রহ করে। সভা থেকে প্রাপ্ত মতামত, তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনা করে কমিশন সুপারিশের খসড়া সারসংক্ষেপ প্রস্তুত করে তা প্রধান উপদেষ্টার কাছে হস্তান্তর করেন।
প্রধান বিচারপতি নিয়োগ :রাষ্ট্রপতি আপিল বিভাগের কর্মে প্রবীণতম বিচারককেই প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করবেন। প্রধান বিচারপতি নিয়োগের প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্রপতির কোনো স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা থাকবে না বা নির্বাহী বিভাগের কোনো প্রভাব থাকবে না। সেই লক্ষ্যে সংবিধানের ৪৮(৩), ৫৫(২) এবং ৯৫(১) অনুচ্ছেদ সংশোধনের প্রস্তাব করেছে কমিশন। সংবিধানের ৯৪(২) অনুচ্ছেদের পরিবর্তে নিম্নরূপ বিধান করার প্রস্তাব করে কমিশন বলছে, আপিল বিভাগের ন্যূনতম বিচারক সংখ্যা হবে সাত জন। প্রধান বিচারপতির চাহিদা মোতাবেক সময়ে সময়ে আরও অধিক সংখ্যক বিচারক নিয়োগ করা হবে। বর্তমানে আপিল বিভাগে বিচারক রয়েছেন প্রধান বিচারপতিসহ মোট পাঁচজন। এছাড়া হাইকোর্ট বিভাগে অতিরিক্ত বিচারক হিসেবে নিয়োগের ক্ষেত্রে একজন প্রার্থীর বয়স অন্যূন ৪৮ বছর করার প্রস্তাব করেছে কমিশন। তবে উচ্চ আদালতে অতিরিক্ত বিচারক নিয়োগে যে আইন প্রণয়ন করতে যাচ্ছে তাতে ৪৫ বছর করার প্রস্তাব করেছে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রণীত খসড়ায়। আপিল বিভাগের বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে হাইকোর্ট বিভাগে কর্মরত বিচারকদের মধ্যে যারা প্রবীণতম তাদের নিয়োগ করার প্রস্তাব করেছে কমিশন। শুধু দায়িত্ব পালন, কর্মদক্ষতা, সততা এবং সার্বিক আচরণের প্রশ্নে জোরালো নেতিবাচক কারণ থাকলেই কমিশন জ্যেষ্ঠতার ব্যত্যয় ঘটাতে পারবেন বলে প্রস্তাব করেছে কমিশন।
সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল :রাষ্ট্রপতি তথা নির্বাহী বিভাগের নির্দেশের পরিবর্তে নিজ উদ্যোগে অনুসন্ধান ও তদন্ত কার্যক্রম যাতে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল পরিচালনা করতে পারে সেজন্য সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ সংশোধনের প্রস্তাব করেছে কমিশন। প্রধান বিচারপতির ব্যাপারে কোনো তদন্ত পরিচালনার ক্ষেত্রে কাউন্সিল একজন অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে গঠিত ও পরিচালিত করার প্রস্তাব রাখা হয়েছে। কাউন্সিলকে স্বীয় কার্যপদ্ধতি নির্ধারণ করার উদ্দেশ্যে বিধি প্রণয়ন করবে এবং পরোয়ানা জারি ও নির্বাহের ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টের ন্যায় একই ক্ষমতা কাউন্সিলকে দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। প্রতি বছর বিচারক ও তাদের ওপর নির্ভরশীল পরিবারের সদস্যদের সম্পদের বিবরণ সংগ্রহ করে তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবে কাউন্সিল। কাউন্সিলের সদস্যরা তাদের নিজেদের সম্পদ বিবরণী জনসাধারণের কাছে প্রকাশ করবে বলে প্রস্তাব করা হয়েছে।
উপজেলা পর্যায়ে আদালতের কার্যক্রম সম্প্রসারণ :উপজেলা সদরের ভৌগোলিক অবস্থান ও বৈশিষ্ট্য, জেলা সদর থেকে দূরত্ব ও যাতায়াতব্যবস্থা, জনসংখ্যার, ঘনত্ব ও বিন্যাস এবং মামলার চাপ বিবেচনা করে কোনো কোনো উপজেলায় আদালত স্থাপন করা প্রয়োজন তা নির্ধারণ করতে হবে। যেসব স্থানে চৌকি আদালত রয়েছে তা সচল রাখার প্রয়োজন আছে কি না তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এছাড়া ঢাকা ও চট্টগ্রামের জনসংখ্যার ঘনত্ব, মামলার সংখ্যা ও আনুষঙ্গিক বিষয় বিবেচনায় নিয়ে আদালত ব্যবস্থাকে অন্তত দুটি এলাকায় বিভাজন, বিচারকের পদ রাজস্ব খাতে স্থায়ীভাবে সৃজনের সুপারিশ করেছে কমিশন।
আরও পড়ুন
ট্রাম্পের প্রতিশ্রুতির পর যুক্তরাষ্ট্রে আবারও চালু টিকটক
বদলে যাচ্ছে পুলিশ, র্যাব ও আনসার সদস্যদের পোশাক
দায়িত্ব নিয়েই নির্বাহী আদেশের ঝড় তোলার প্রতিশ্রুতি ট্রাম্পের